অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় । বাঙালি সঙ্গীতশিল্পী, সুরকার, গীতিকার, সঙ্গীত পরিচালক

অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন বাংলা গানের স্বর্ণযুগের একজন খ্যাতনামা সুরকার। চলচ্চিত্রের সঙ্গীত পরিচালক ছাড়াও গীতিকার হিসাবেও তিনি সুপরিচিত ছিলেন। সলিল চৌধুরীর “স্যাটেলাইট” বলা হত যে তিনজনকে তাদের অন্যতম ছিলেন তিনি। অন্য দুজন ছিলেন – অনল চট্টোপাধ্যায় ও প্রবীর মজুমদার (১৯২৮-১৯৯০)।

অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় । বাঙালি সঙ্গীতশিল্পী, সুরকার, গীতিকার, সঙ্গীত পরিচালক

জন্ম ও প্রারম্ভিক জীবন

অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দের ২৪ জুলাই উত্তর কলকাতার এক ব্রাহ্ম পরিবারে।তবে তার শৈশব ও বাল্যকাল কেটেছে দক্ষিণ কলকাতার ঢাকুরিয়ায়। রামচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ে তার পড়াশোনা। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে ম্যাট্রিক পাশ করেন। পিতা নিরাময় বন্দ্যোপাধ্যায় সহ পরিবারের সকল সদস্যের সঙ্গীতের যোগসূত্র ছিল। মেজোজ্যেঠা নিরুপম বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন ধ্রুপদী শিল্পী। মাতা লাবণ্য বন্দ্যোপাধ্যায় অর্গানে মত হারমোনিয়াম বাজাতেন।

সঙ্গীতশিল্পী অগ্রজ অরিন্দম বন্দ্যোপাধ্যায় গানও রচনা করতেন। স্বভাবতই ছোটবেলা থেকেই অভিজিতের সঙ্গীতের প্রতি আগ্রহ বাড়ে এবং অগ্রজের কাছে তার সঙ্গীতের হাতেখড়ি এবং অগ্রজের রচিত এক গানে তার প্রথম সুরারোপ। ব্রাহ্ম পরিবারের সূত্রে রবীন্দ্রের প্রভাবের জন্য তার সেই গানের সুর হল রবীন্দ্রসঙ্গীতের ধরনের।

অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় । বাঙালি সঙ্গীতশিল্পী, সুরকার, গীতিকার, সঙ্গীত পরিচালক

সঙ্গীত জীবন

অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গীতজগতে আত্মপ্রকাশ ঘটে ভারতীয় গণনাট্যের মাধ্যমে। এখানে বামপন্থায় বিশ্বাসী তিনি সলিল চৌধুরীর শুধু অন্যতম সহকারী নয় শিষ্যও ছিলেন। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে, প্রবীর মজুমদার এবং অনল চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে তিনি সলিল চৌধুরীর সঙ্গে মাঝে মধ্যেই মিলিত হতেন। এর মধ্যে প্রখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী সুবীর সেনের সতীর্থ তিনি শাস্ত্রীয় সংগীতের তালিম নেন উষারঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে।

পিয়ানো বাজানো শেখেন ভি বালসারার কাছে। সরকারি চাকরির সঙ্গে সঙ্গীত চর্চা নিয়ে ব্যস্ত রইলেন। বাংলা গানের আঙ্গিনায় তার পরিচিতি ঘটে কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের দূরের পাল্লা কবিতাটিতে সুরারোপ করে। তিনি অগ্রজের জোরাজুরিতেই কবিতার সুর দিয়েছিলেন। শেষে সলিল চৌধুরী র পরামর্শে ও সহযোগিতায় গানটি গাওয়ালেন শ্যামল মিত্রকে দিয়ে।

গণনাট্য পর্বে ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে অনল চট্টোপাধ্যায়ের কথা ও অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুরে ‘কোথায় সোনার ধান’ রেকর্ডে প্রকাশ হওয়ায় জনমানসে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি হয়। সেই সময় থেকে শুরু করে বহু বাংলা আধুনিক গানের অসামান্য সুরারোপ করেছেন তিনি। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সনৎ সিংহ, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, সুবীর সেন সহ প্রবাদপ্রতিম একাধিক শিল্পীর কণ্ঠের গান বেজে উঠেছিল তাঁর সুরে।

অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় । বাঙালি সঙ্গীতশিল্পী, সুরকার, গীতিকার, সঙ্গীত পরিচালক

তার সঙ্গীত পরিচালনায় চলচ্চিত্রে গেয়েছেন মান্না দে, লতা মঙ্গেশকর, আশা ভোঁসলের মতো কিংবদন্তি শিল্পীরাও। তার সঙ্গীত পরিচালনা শুরু হয় ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে “অশ্রু দিয়ে লেখা” ছবিতে। তবে বাংলা আধুনিক গানের তুলনায় বাংলা ছবিতে কাজ কম। তিনি শেষ সঙ্গীত পরিচালনা করেন ঋণমুক্তি ছবিতে ২০০০ খ্রিস্টাব্দে।

জীবনে গান লিখেছেন অনেক, আর রচিত গানের ইতিবৃত্ত নিয়ে রচনা করেছেন- ‘কিছু ভাবনা কিছু কথা’ গ্রন্থ। গানের পাশাপাশি লিখতেন কবিতাও। তার লেখা একমাত্র কাব্যগ্রন্থটি হল- ‘ঝড়ের রাতের পাখি’। তবে বাংলা গানের আকর গ্রন্থ হল – বাংলা গানের পথ চলা যার প্রতিটি কবিতায় রয়েছে মানব জীবন যাপনের প্রতিটি মুহূর্ত আর সংগ্রামী মানুষের ছবি। এখানেই তিনি রবীন্দ্রনাথকে চিহ্নিত করেন আধুনিক বাংলা গানের দিশারী হিসেবে। তার আর একটি গ্রন্থ হল-অকিঞ্চনের কড়চা।

অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় । বাঙালি সঙ্গীতশিল্পী, সুরকার, গীতিকার, সঙ্গীত পরিচালক

জীবনাবসান

আধুনিক বাংলা গানের সুরের নিপুন কারিগর সুরকার অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বার্ধক্যজনিত রোগে বেশ কিছুদিন ভুগছিলেন। কয়েকদিন হাসপাতালে ভর্তিও হয়েছিলেন এবং পরে বাড়িতে ফিরে আসেন। কিন্তু ২০২২ খ্রিস্টাব্দের ২১ফেব্রুয়ারি ভাষা দিবসের সকালে শেষ নিঃশ্বাসত্যাগ করেন। তার দুই পুত্র অমিত ও অভিষেক এবং এক কন্যা মহাশ্বেতা সকলেই সঙ্গীতের সাথে যুক্ত। সঙ্গীতশিল্পী অগ্নিভ বন্দ্যোপাধ্যায় তার ভ্রাতুষ্পুত্র।

আরও দেখুনঃ

3 thoughts on “অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় । বাঙালি সঙ্গীতশিল্পী, সুরকার, গীতিকার, সঙ্গীত পরিচালক”

Leave a Comment