আজ ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শনিবার রাত ১০টা ১৫ মিনিটে ফরিদা পারভীন চলে গেলেন না–ফেরার দেশে (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তাঁর মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছেন ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আশীষ কুমার চক্রবর্তী। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭১। তিনি স্বামী, তিন পুত্র ও এক কন্যা রেখে গেছেন। দীর্ঘদিন কিডনি জটিলতায় ভুগতে থাকা এই মহারথীকে শেষ পর্যন্ত ভেন্টিলেশনে রাখা হলেও চিকিৎসকদের সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়।
Table of Contents
লালনসংগীতের মহারথী ফরিদা পারভীন প্রয়াণ
ফরিদা পারভীন কত বড় শিল্পী ছিলেন, তা বোঝার মেধা বা ক্ষমতা আমাদের দেশের অধিকাংশেরই ছিল না। আজকের শূন্যতাও হয়তো আমাদের সেই সত্য বোঝাতে পারবে না।
আমাদের মতো মূর্খ, গোয়ার, বেয়াদব, অসংবেদনশীল, নিম্নরুচির, পরশ্রীকাতর জাতির জন্য ফরিদা পারভীন বড্ড বেশি ছিলেন। আমাদের এতটা প্রাপ্য ছিল না।
শৈশব ও বেড়ে ওঠা
১৯৫৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর নাটোর জেলার সিংড়া থানায় জন্মগ্রহণ করেন ফরিদা পারভীন। বাবার চাকরির কারণে শৈশব ও কৈশোর কেটেছে মাগুরা, কুষ্টিয়া, রাজশাহীসহ বিভিন্ন জেলায়। ছোটবেলা থেকেই সঙ্গীতের প্রতি প্রবল আকর্ষণ ছিল তাঁর। মাগুরায় ওস্তাদ কমল চক্রবর্তীর কাছে সংগীতের হাতেখড়ি হয়। এরপর বিভিন্নজনের কাছ থেকে নজরুলসংগীত, আধুনিক গানসহ বিভিন্ন ধারার সঙ্গীতে তালিম নেন।
তাঁর শৈশব ছিল প্রাণবন্ত—আত্রাই নদীর তীরে খেলা, মামাতো ভাই–বোনদের সঙ্গে শাপলা তোলা, রেডিওতে গান শোনা—এসব অভিজ্ঞতা তাঁর সৃজনশীলতাকে সমৃদ্ধ করেছিল।
শিল্পীজীবনের শুরু
১৯৬৮ সালে মাত্র ১৪ বছর বয়সে রাজশাহী বেতারে নজরুলসংগীতশিল্পী হিসেবে তাঁর নাম তালিকাভুক্ত হয়। প্রথমদিকে নজরুলসংগীত ও আধুনিক গান গাইলেও তাঁর প্রকৃত পরিচিতি আসে লালন সাঁইয়ের গান পরিবেশনের মধ্য দিয়ে।
কুষ্টিয়ায় পারিবারিক বন্ধু মোকছেদ আলী সাঁইয়ের উৎসাহে তিনি প্রথম লালনগীতি শিখেন। “সত্য বল সুপথে চল” গানটি দিয়েই লালনের গান পরিবেশনের যাত্রা শুরু হয় তাঁর। দোলপূর্ণিমার আসরে সেই পরিবেশনার পর থেকেই লালনের গান হয়ে ওঠে তাঁর জীবনের অঙ্গ। পরবর্তীতে খোদা বক্স সাঁই, ব্রজেন দাস, বেহাল সাঁই, ইয়াছিন সাঁই এবং করিম সাঁইয়ের কাছ থেকেও তিনি তালিম নেন।
সঙ্গীত ক্যারিয়ার ও অবদান
ফরিদা পারভীনের কণ্ঠে লালনের গান যেন এক নতুন প্রাণ পেল। তাঁর কণ্ঠ লালনের আধ্যাত্মিক দর্শনকে জনমানসে গভীরভাবে প্রতিষ্ঠিত করে। শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বমঞ্চেও তিনি লালনগীতি পৌঁছে দেন—জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, সুইডেনসহ বহু দেশে তিনি লালনের গান পরিবেশন করেছেন।
তাঁর গাওয়া আধুনিক গানও জনপ্রিয় হয়েছে—“তোমরা ভুলে গেছ মল্লিকাদির নাম”, “এই পদ্মা এই মেঘনা”সহ বেশ কিছু গান মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছে।
স্বীকৃতি ও পুরস্কার
একুশে পদক (১৯৮৭) – লালনসংগীতে বিশেষ অবদানের জন্য
জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (১৯৯৩) – ‘অন্ধ প্রেম’ চলচ্চিত্রে ‘নিন্দার কাঁটা’ গানের জন্য শ্রেষ্ঠ নারী কণ্ঠশিল্পী
ফুকুওয়াকা এশিয়ান কালচার পুরস্কার (২০০৮) – এশিয়া মহাদেশে সাংস্কৃতিক অবদানের জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি
পরিবার ও ব্যক্তিজীবন
ফরিদা পারভীনের প্রথম স্বামী ছিলেন কণ্ঠশিল্পী ও গীতিকার আবু জাফর। তাঁদের সংসারে তিন ছেলে ও এক মেয়ে—জিহান ফারিয়া, ইমাম নিমেরি উপল, ইমাম নাহিল সুমন ও ইমাম নোমানি রাব্বি।
শেষ দিনগুলো
গত কয়েক বছর ধরে কিডনি জটিলতায় ভুগছিলেন তিনি। সপ্তাহে দুই দিন ডায়ালাইসিস নিতে হতো। সেপ্টেম্বরে শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। আইসিইউ ও ভেন্টিলেশনেও তাঁকে বাঁচানো যায়নি। ১৩ সেপ্টেম্বর রাতে তিনি আমাদের ছেড়ে চলে যান।
উত্তরাধিকার
ফরিদা পারভীনের প্রস্থান শুধু একজন শিল্পীর মৃত্যু নয়, বরং একটি যুগের অবসান। তিনি ছিলেন লালনের গানকে মানুষের আধ্যাত্মিক চেতনায় পৌঁছে দেওয়ার সেতুবন্ধন। তাঁর গান আমাদের স্মৃতিতে, আমাদের সংস্কৃতির ভাণ্ডারে অমর হয়ে থাকবে।
সঙ্গীত গুরুকুলের শ্রদ্ধা
আমরা সঙ্গীত গুরুকুলের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি এই মহীয়সী শিল্পীকে। লালনের গান বিশ্ব দরবারে পৌঁছে দেওয়ার যে অসামান্য কাজ তিনি করেছেন, তা প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। তাঁর বিদায় মানেই এক অপূরণীয় শূন্যতা। আমরা তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করি এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাই।