হিমাংশু কুমার দত্ত, হিমাংশু দত্ত [ Himangshu Dutta ]

হিমাংশু দত্ত : এই পৃথিবীর বুকে এমন কিছু ক্ষণজন্মা প্রতিভা আসেন, যাঁরা গতানুগতিক পথে না চলেও জীবনের শুরু থেকে নিজের অস্তিত্ব প্রকাশে প্রথম সারির গুণীজনের মধ্যে বিশেষ একজন হয়ে ওঠেন। সুরসাগর হিমাংশু কুমার দত্ত তাঁদের মধ্যে অন্যতম এক ব্যক্তিত্ব।

হিমাংশু কুমার দত্ত, হিমাংশু দত্ত [ Himangshu Dutta ]
হিমাংশু কুমার দত্ত
ত্রিপুরা রাজ্যের কুমিল্লা জেলা শহরে ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দে (ভিন্নমতে ১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দ) জন্মগ্রহণ করেন বিদগ্ধ এই সংগীতগুণীজন। মা নীরদা দেবী এবং পিতা যোগেন্দ্র চন্দ্র দত্তের পঞ্চম সন্তান হিমাংশু শৈশব থেকেই ছিলেন সংগীতপিপাসু এক বিস্ময়কর প্রতিভা । মা রবীন্দ্রসংগীত ও ভক্তিমূলক গানে এবং বড় ভাই শচীন্দ্রকুমার দত্ত শাস্ত্রীয় সংগীত ও যন্ত্রসংগীতে ছিলেন বিশেষ পারদর্শী।

বালক হিমাংশু দত্ত মায়ের কাছে ভক্তিমূলক সংগীত ও ভাইয়ের কাছে সংগীতের স্বরলিপি সম্বন্ধে প্রয়োজনীয় জ্ঞান অর্জন করেন। পরবর্তীকালে নিজ প্রতিভাগুণে তিনি রবীন্দ্রসংগীতের স্বরলিপি অত্যন্ত নির্ভুল ও সুনিপুণভাবে গাইতে পারতেন। তাঁর কণ্ঠ ছিল সুমধুর ও আকর্ষণীয় এবং বিভিন্ন ছন্দ ও তাল সম্বন্ধে হয়ে উঠেছিলেন অপরিসীম জ্ঞানের অধিকারী।

বাল্যকালেই মায়ের কাছে সংগীতের হাতে খড়িসহ প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন তিনি। অতঃপর বড় ভাই শচীন্দ্রকুমার দত্তের কাছে শাস্ত্রীয় সংগীত, পণ্ডিত ক্ষিতিমোহন সেন শাস্ত্রীর কাছে ভজন, আচার্য শ্যামাচরণ দত্তের কাছে ধ্রুপদ এবং শাস্ত্রীয় সংগীতগুরু ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খসরু সাহেবের কাছে শাস্ত্রীয় সংগীতের ব্যাপক তালিম গ্রহণের সুযোগ পান হিমাংশু কুমার দত্ত। সে সময় কুমিল্লাতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ভজন ও ব্রহ্মসংগীত পরিবেশন করে তিনি ভূয়সী প্রশংসার অধিকারী হন।

সংগীতাচার্য পণ্ডিত বিষ্ণু নারায়ণ ভাতখণ্ডে রচিত ক্রমিক পুস্তক মালিকা গ্রন্থের ছয়টি খণ্ডের প্রায় সকল রাগাশ্রিত গান তিনি আয়ত্ত করেছিলেন। তাঁর সময়ে কুমিল্লা জেলা ‘সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের পীঠস্থান’ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল। হিমাংশু কুমার দত্ত ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে কুমিল্লা জিলা স্কুল থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণিতে ভর্তি হন।

লেখাপড়া চলাকালীন নানা বাধাবিপত্তি পেরিয়ে অবশেষে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন বিদ্যাসাগর কলেজ থেকে বিএসসি ডিগ্রি অর্জন করেন। অ্যাকাডেমিক লেখাপড়ার মধ্যে থেকেও সুরের সাধনা করে অচিরেই তিনি সংগীতজগতে সুরস্রষ্টা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। ব্যক্তিজীবনে না পাওয়ার ব্যথা এই প্রতিভাবান শিল্পীকে ভিন্ন খাতে চালিত করে। ফলে তাঁর সুরারোপিত গানগুলো করুণ রসে সিক্ত হয়ে অনাবিল মূর্ছনা সৃষ্টি করেছিল।

হিমাংশু কুমার দত্ত, হিমাংশু দত্ত [ Himangshu Dutta ]

হিমাংশু কুমার দত্তের সময়ে কুমিল্লার কয়েকজন প্রখ্যাত কবি ও গায়ক সংগীতের ভুবনে বেশ সুনাম অর্জন করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে কবি ও গীতিকার অজয় ভট্টাচার্য ও সুবোধ পুরকায়স্থ (শচীন দেববর্মন) গান লিখতেন। সেই গানগুলোতে সুরারোপ করতেন হিমাংশু কুমার এবং সেগুলো পরিবেশন করতেন শচীন দেববর্মন।

‘ছিলো চাঁদ মেঘের পারে’, ‘চাঁদ ভুলে নাই চামেলিরে’, ‘তায় চামেলি ভুলেনি চাঁদে’ এরকম চাঁদ-চামেলিযুক্ত অনেক করুণ রসাত্মক গান সে সময়ের সংবেদনশীল মনকে দারুণ ভারাক্রান্ত করে তুলত। তখন হালকা রসাত্মক গানের বিশেষ স্থান বা কদর থাকলেও হিমাংশু দত্তের স্বকীয় বৈশিষ্ট্য করুণ রসাত্মক ও বিরহের রসে সিক্ত অশ্রুভরা বেদনার সুরধ্বনি সাধারণ মানুষের হৃদয়ে অভূতপূর্ব আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল সুরকার হিমাংশু কুমার দত্তের নতুন সৃজনশীল সুরের পুরস্কার হিসেবে ‘ভাটপাড়া সারস্বত সমাজ’ তাঁকে ‘সুরসাগর’ উপাধি প্রদানের মাধ্যমে সম্মানিত করে।

বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে বাংলার সংগীতাকাশে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ও কাজী নজরুল ইসলামের গান মানুষের হৃদয়ে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেছিল। সুরসাগর সুরারোপিত গানগুলো সে সময় তাঁদের প্রভাবমুক্ত হয়ে একটু ভিন্ন মাত্রা প্রদানে সক্ষম হয়েছিল।

পাশ্চাত্য সুরকে স্বকীয় বৈশিষ্ট্যগুণে তিনি এমনভাবে বাংলা গানে প্রয়োগ করেছিলেন, যা হিমাংশু কুমারের স্বকীয়তার সাক্ষ্য বহন করে। তাঁর সুরারোপিত গানগুলোর মধ্যে ‘মম মন্দিরে’, ‘আলোছায়া দোলা’, ‘ডাক দিয়ে যায় কে গো আমায় বাজিয়ে বাঁশি’, ‘তব স্মরণ লাগি’, ‘নতুন ফাগুন’, ‘কোন সে সুদূর অশোক কাননে বন্দিনী তুমি সীতা’, ‘রাতের ময়ূর ছড়ালো যে পাখা’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

এসব ছাড়াও তৎকালীন চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত তাঁর সুরারোপিত বহু গান এবং তাঁর সৃষ্ট রাগ ‘পুষ্প্য চন্দ্রিকা’ ও ‘মিশরী টোড়ি’ সুরসাগরকে চির অমর করে রাখবে। সুরসাগর হিমাংশু কুমার দত্ত তাঁর ব্যথা ভারাক্রান্ত জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে ১৯৪৪ খ্রিষ্টাব্দে চিরশান্তির কোলে আশ্রয় গ্রহণ করেন।

হিমাংশু দত্তের জনপ্রিয় গানসমূহ

তুমি তো বঁধু জান
নতুন ফাগুন যবে
বরষার মেঘ ডাকে ঝড় বরিষণে
মম মন্দিরে
আলোছায়া দোলা
আবেশ আমার যায় উড়ে কোন ফাল্গুনে
চাঁদ কহে চামেলি গো
রাতের দেউলে জাগে বিরহী তারা
খুঁজে দেখা পাইনে যাহার
ডাক দিয়ে যায় কেগো আমার বাজিয়ে বাঁশি
তব স্মরণখানি
তোমারই পথ পানে চাহি
রাতের ময়ূর ছড়ালো যে পাখা
ছিল চাঁদ মেঘের পারে

আরও পড়ুন:

1 thought on “হিমাংশু কুমার দত্ত, হিমাংশু দত্ত [ Himangshu Dutta ]”

Leave a Comment