সঙ্গীত কি ? এই বানানটি “কি” এর বদলে “কী” দিয়ে লেখা প্রয়োজন ছিল। কিন্তু বেশিরভাগ অনুসন্ধান “কি” দিয়েই হয় বলে “কি” লিখতে বাধ্য হলাম। যাহোক মূল কথায় ফেরা যাক।
সঙ্গীত এমন একটি বিষয়, যার চেহারা প্রতিজন শ্রোতার কাছে ভিন্নরকম। তাই একজন মানুষের পক্ষে সঙ্গীতকে কিছু শব্দ দিয়ে সংজ্ঞায়িত করা অত্যন্ত কঠিন। যারা সংজ্ঞায়িত করেছেন, তারা তাদের স্থান-কাল ও সেই অনুযায়ী তাদের অনুভব ও দৃষ্টিভঙ্গি থেকে করেছেন। শিক্ষার্থী হিসেবে আমাদের উচিৎ তাদের সবার সেসব সংজ্ঞা অধ্যয়ন করা। সেসব সংজ্ঞা পরিষ্কার ভাবে বুঝতে চেষ্টা করা। এরপর নিজের বোধের থেকে নিজের একটি সংজ্ঞা তৈরি করে নেয়া। পরবর্তীতে বোধের উন্মেষের সাথে সাথে সেই সংজ্ঞাকেউ উন্নীত করা। তাই “সঙ্গীত কি” সেটা এক কথায় সবার জন্য উত্তর দেয়া কঠিন।
আমরা জানি পৃথিবীতে ললিতকলার যতগুলো শাখা রয়েছে, তার মধ্যে সঙ্গীতকেই সর্বশ্রেষ্ঠ। সর্বশ্রেষ্ঠ বলছি কারণ যুগে যুগে সর্বশ্রেষ্ঠ হিসেবে মানা হয়েছে, অন্তত শাস্ত্রমতে আমরা যা পাই। আদিকাল থেকে প্রচলিত হলেও প্রতিটি যুগে বিশিষ্ট সঙ্গীতকারদের মাধ্যমে উত্তরোত্তর উন্নতি লাভ করেছে। পৃথিবীর বিভিন্ন সভ্যতায় বিভিন্ন ভাবে এগিয়ে চলেছে এই শিল্প। শুধুমাত্র শ্রেষ্ঠই নয়, ললিতকলার সকল শাখার মধ্যে এই কলাটিই সবচেয়ে বেশি চর্চিত ললিতকলা।
সঙ্গীত কি – সেই উত্তর খুঁজতে – বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্বভারতী স্থাপনকালে তার ভাষণটি শোনা যেতে পারে। তিনি তার ভাষণে বলেছেন, “সংগীত এবং ললিতকলাই যে জাতীয় আত্মবিকাশের প্রকৃষ্ট উপায় এ কথার পুনরুল্লেখ করাই বাহুল্য, যে জাতি এই দুটি বিচ্ছা থেকে বঞ্চিত তারা চিরমৌন থেকে যায়।”
সাধারণভাবে ‘সঙ্গীত’ বলতে আমরা গীত বা গানকেই বুঝে থাকি। বা বড়জোর যন্ত্রসঙ্গীতকে বুঝি। আমরা যা বলি তা হলো, সুর বা লয় দিয়ে যা গাওয়া বা বাজানো হয়, তাই সঙ্গীত। তার সাথে বড়জোর শর্ত জুড়ে দেই জিনিসটা সুরেলা হতে হবে এবং শ্রুতিমধুর হতে হবে। কিন্তু আমাদের ভারতবর্ষের সনাতন শাস্ত্রমতে এর সংজ্ঞা আরও বিস্তর। সঙ্গীত বিষয়ক প্রাচীন শাস্ত্র বা গ্রন্থ গুলোতে গীত-বাদ্য-নৃত্য, এই তিন কলার সমন্বয়কে সঙ্গীত বলা হয়েছে।
Table of Contents
সঙ্গীত কি – এই প্রশ্নে মধ্যযুগের বিশিষ্ট সঙ্গীতজ্ঞ শারঙ্গদেব (১১৭৫-১২৪৭) তাঁর বিখ্যাত সঙ্গীত রত্নাকর গ্রন্থে বলেছেন :
‘গীতং বাদ্যং তথা নৃত্যং ত্রয়ং সঙ্গীত মুচ্যতে ॥’
অর্থাৎ, গীত-বাদ্য-নৃত্য এই তিনটি কলার সমষ্টির নাম সঙ্গীত।’
লক্ষণীয় বিষয় হলো, উল্লেখিত তিনটি কলা পৃথক পৃথক বটে, তবে পরস্পর এর সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত, এমনকি একটি অপরটির পরিপূরক। তবে তিনটি কলার মধ্যে সবসময় গীত বা গানকেই শ্রেষ্ঠ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে । সঙ্গীতবিষয়ক প্রাচীন গ্রন্থগুলো আমাদের জানায় – গীতের অধীনে বাদ্য এবং বাদ্যের অধীনে নৃত্য।
মজার বিষয় হচ্ছে, যুগযুগ ধরে গান শেখানোর মাধ্যম হিসেবে গানই ব্যবহার হচ্ছে। অর্থাৎ মুখে গেয়ে পরবর্তী প্রজন্মকে বিদ্যাটি শিক্ষা দেয়া হয়। আর এই একই মাধ্যম ব্যবহার করে, অর্থাৎ গেয়ে শিক্ষা দেয়া হয় “বাদ্য” ও “নৃত্য”। তাই তিনটি মাধ্যমের জন্য গীত বা গান হচ্ছে প্রাণ। এটিও উন্নত হিসেবে বিবেচিত হবার একটি কারণ।
জপকোটিগুণং ধ্যানং ধ্যানকোটিগুণং লয়।
লয়কোটিগুণং গানং গানাৎ পরতরং নহি ॥
এমন উচ্চতম প্রশংস। আর কোন বিষয়ে নেই। সংগীত যে সর্বকালের সর্বদেশের সর্বজনের প্রেমভক্তি ও সম্মানের সর্বশ্রেষ্ঠ বিদ্যা, সর্বদেশের মনীষীগণ সে কথা স্বীকার করেন। মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব আমলের বিশিষ্ট সঙ্গীতজ্ঞ ও সুপণ্ডিত, পণ্ডিত অহোবল তাঁর সংস্কৃতিতে লিখিত “সঙ্গীত পারিজাত” গ্রন্থে সংগীতকে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে যা বলেছেন তার অর্থ বের করলে দাড়ায় :
‘গীত বাদ্য নৃত্য এই তিনটি কলাকে সম্মিলিতভাবে পরিবেশন করাকেই বলে সঙ্গীত।’
[সঙ্গীত কি? [ What is Music ] ]
পণ্ডিত অহোবলও তিনের মধ্যে গীতকেই প্রধান হিসেবে দেখিয়েছেন। সকল বিজ্ঞজনের মত বিশ্লেষণ করে, এবং অন্য দুটি শিল্প ক্রমশ স্বতন্ত্রতা নিয়ে প্রতিষ্টিত হওয়ায়, কালের বিবর্তে ক্রমশ “কণ্ঠসঙ্গীত”ই “সঙ্গীত” হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। তাছাড়া ‘সঙ্গীত’ শব্দটি ভাংলে দেখা যায়, ‘সং’ অর্থ ‘উত্তমরূপে’ আর ‘গীত’ অর্থ ‘গান’।
তার মানে, উত্তমরূপে গান করাকেই বলা হবে সঙ্গীত। যেকোনো জ্ঞানের পূর্ণতার জন্য ঐতিহাসিক পেক্ষাপট এবং বিবর্তন জানা প্রয়োজন। তাই ঐতিহাসিক ভাবে এটা আমরা সত্য মানবো যে, গীত-বাদ্য-নৃত্য তিনটি কলার সমন্বিত রূপই হচ্ছে সঙ্গীত । আবার বিবর্তনের মাধ্যমে “গান” বা “গীত”ই এখন সঙ্গীত বলে বিবেচিত, সেটিও আমরা জানবো। এখন তিনটি শিল্পমাধ্যম সম্পর্কে আমরা প্রাথমিক ধারণা নেবো।
প্রথমে গীত: গীত মানে যা সুর করে গাওয়া হয়। আরেকটু স্পষ্ট করলে লয় ও তাল সহযোগে যখন কোনো সুর গাওয়া হয় তখন হয় গীত। সেটির সাথে অর্থবোধক বাণী যুক্ত করলে, শ্রোতার চিত্তকে প্রসন্ন করে। তাই এই তিনটি জিনিসের মিলন কে গীত বলা যেতে পারে।
আজকের পৃথিবীতে সঙ্গীতের বৈচিত্র অনেক হয়ে দাড়িয়েছে। সেটি শাস্ত্রীয় সঙ্গীত থেকে শুরু করে রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলসঙ্গীত, দ্বিজেন্দ্রগীতি, রজনীকান্তের গান, অতুল প্রসাদের গান, আধুনিক গান, পল্লীগীতি, ফিল্ম প্লেব্যাক, পপ, রক, জ্যাত ইত্যাদি।
এরপর বাদ্য: বাদ্য একসময় গীতকে সঙ্গত করাতেই সীমাবদ্ধ ছিল। মুল গীতের সাথে তাল বা সুর মিলিয়ে, মুল গীতকে আরও আকর্ষণীয় করে উপস্থাপনই ছিল উদ্দেশ্য। যেটি করা হতো বিশেষ ভাবে তৈরি যন্ত্র দিয়ে। যেমন তাল দেবার জন্য পাখোয়াজ, ঢোল, তবলা-বাঁয়া বা কাঁসি ইত্যাদি। আবার তার যন্ত্রের মধ্যে তানপুরা, সরোদ,সারেঙ্গী, সেতার, বীণা ইত্যাদি। বাতাসের সাহায্যে বাজানোর মতো বিভিন্ন ধরনের বাঁশি। পরে যোগ হয়েছে যেমন হারমোনিয়াম, বেঞ্জু,গিটার ইত্যাদি।
এগুলো বিভিন্ন সময় শুধুমাত্র সঙ্গীত সহায়ক বাদ্য হিসেবেই আত্মপ্রকাশ করেছে। তবে এর মধ্যে অনেক যন্ত্রই সময়ের সাথে সাথে একক ভাবে, তাল ও লয় সহযোগে মানুষের মনকে প্রফুল্ল করার সক্ষমতা প্রমাণ করেছে। তখন বাদ্যর বাজনাই আবার হয়ে উঠেছে সঙ্গীত, যেমন – বাঁশি, সেতার, সরোদ, বীণা, সরোদ,সারেঙ্গী ইত্যাদি। তাই আমরা যেভাবে ভাবতে পারি তা হলো যখন যন্ত্র গীতকে সহায়তা করছে, তখন সে শুধু বাদ্য যন্ত্র। যখন সেই বাদ্যযন্ত্র নিজে সঙ্গীতের নেতৃত্ব দিয়ে মানুষের মনোরঞ্জন করছে, তখন সেই বাদনটিও সঙ্গীত।
এরপর নৃত্য : একসময় বলা হতো তাল ও লয় সহযোগে ছন্দোবদ্ধ অঙ্গভঙ্গি যখন দর্শকের মনোরঞ্জন করে তখন তাকে নৃত্য বলে। তবে বর্তমান সময়ে নৃত্যর পূর্ণ অর্থ অভিনয়, যা ছন্দোবদ্ধ অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে করা হয় এবং বিস্তারিত ভাব প্রকাশে সক্ষম হয়। এখন যেমন নৃত্যের পূর্ণদৈর্ঘ্য কম্পোজিশন হয় এবং যার অর্থপ্রকাশের ক্ষমতা বাক্যসহ অভিনয়ের চেয়ে কম নয়। প্রচলিত নাটকের ফর্ম গুলো – কথক, ভারতনাট্যম, মণিপুরি, কথাকলি, লোকনৃত্য, আধুনিক নৃত্য, দেশি নৃত্য ইত্যাদি। থিমেটিক কম্পোজিশনে বিভিন্ন ফর্মের অঙ্গভঙ্গির সমন্বয় ঘাঁটানো হতে পারে।
অমল দাশশর্মা তার বইয়ে লিখেছেন:
জপকোটিগুণং ধ্যানং ধ্যানকোটিগুণং লয়:।
লয়কোটিগুণং গানং গানাৎ পরতরং নহি ॥সঙ্গীত কী, কেন, কীভাবে?
এমন উচ্চতম প্রশংসা আর কোন বিষয়ে নেই। সঙ্গীত যে সর্বকালের সর্বদেশের সর্বজনের প্রেমভক্তি ও সম্মানের সর্বশ্রেষ্ঠ বিদ্যা, সর্বদেশের মনীষীগণ সে কথা স্বীকার করেন। গোড়ার দিকে পৃথিবীর সর্বত্রই সঙ্গীত ছিল ধর্মীয় অনুষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত, কিন্তু সমাজ, ধর্ম, লোকরুচি, জলবায়ু, ভাষা প্রভৃতি অনুসারে ক্রমে এর নানাবিধ রূপান্তর ঘটে। তবে ভারতীয় সংগীতের প্রধান উপাদান ও আধিপত্য চিরদিনই ধর্মভাবাপন্ন। সুরের আবেশে মুগ্ধ ভক্তেরা ছুটে চলেছে মুক্তির সন্ধানে, এমন অজস্র দৃষ্টাস্ত দেখা যায়। এ দেশের জয়দেব, শ্রীচৈতন্য, তুলসী, কবীর, ত্যাগরাজ, পুরন্দরদাস, সুরদাস, মীরা, রামপ্রসাদ প্রমুখ পরম ভক্তেরা এই প্রসঙ্গে চিরস্মরণীয়। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন :
নাহং তিষ্ঠামি বৈকুণ্ঠে যোগীনাং হৃদয়ে ন চ।
মদভক্ত যত্র গায়স্তি তত্র তিষ্ঠামি নারদঃ ॥
আমাদের দেশে সাধারণ লোকশিক্ষা থেকে উচ্চতম জ্ঞানের বাণী পর্যন্ত স্থরে প্রচারিত হয়েছে। এ দেশের চাষী, মজুর, মাঝি প্রভৃতি সকলেই গান গায়। ভিক্ষুকেরও প্রধান অবলম্বন হোল গান। পৃথিবীর আর কোথাও এমনটি দেখা যায় না। অর্থাৎ ভারতীয় সমাজজীবনের প্রাণের লক্ষণই হোল গান গাওয়া। আধুনিককালের বৈজ্ঞানিকেরা শস্যাদির উৎকর্ষসাধনেও সংগীতের উপযোগিতা প্রমাণ করেছেন। পশুপক্ষীরা যে সংগীতে মুগ্ধ হয়ে থাকে সে কথার পুনরুল্লেখ করাই বাহুল্য। সুতরাং সঙ্গীত প্রাণীমাত্রেরই জীবনে অমৃতধারা, এবং যে কোন প্রশংসাই এ বিষয়ে অকিঞ্চিৎকর। সংগীতের প্রশংসায় এবং এর মহত্ব বর্ণনায় দেশবিদেশের মনীষীগণ যে-সকল উক্তি করেছেন তার কয়েকটি এখানে দেওয়া হোল ।
স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, “সঙ্গীত সর্বশ্রেষ্ঠ ললিতকলা এবং যারা তা বোঝেন তাদের নিকট উহা সর্বশ্রেষ্ঠ উপাসনা।”
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্বভারতী স্থাপনকালে তার ভাষণে বলেছেন, “সঙ্গীত এবং ললিতকলাই যে জাতীয় আত্মবিকাশের প্রকৃষ্ট উপায় এ কথার পুনরুল্লেখ করাই বাহুল্য, যে জাতি এই দুটি বিঘা থেকে বঞ্চিত তারা চিরমৌন থেকে যায়।”
পাশ্চাত্য কবি ও নাট্যকার উইলিয়াম কংগ্রেভ (William Congrave ) বলেছেন: “Music hath charms to soothe the Savage’s beast. To soften rocks, or bend a knotted oak… “
“জগদ্বিখ্যাত সেক্সপিয়ার বলেছেন :
“The man that hath no music in himself,
Nor is not mov’d with concord of sweet sounds,
Is fit for treasons, stratagems, and spoils;
The notions of his spirit are dull as night
And his affections dark as Erebus.
Let no such man be trusted, Mark the music.”(Merchant of Venice-Act V-Scenel)
সংগীত যেন একটি আধ্যাত্মিক ভাষা, যার মাধ্যমে প্রকাশ পায় মানব হৃদয়ের বিভিন্ন অভিব্যক্তি। সংগীতের মাধ্যমে আমরা পাই হৃদয়াবেগ প্রকাশের বিস্তীর্ণ ক্ষেত্র, যার প্রকাশ হয় সুর, ছন্দ ও কাব্যের ত্রিবেণী সঙ্গমে।
সঙ্গীত সম্পর্কে অন্যান্য রেফারেন্স:
- উইকিপিডিয়া : সঙ্গীত
- সুফি ফারুক ইবনে আবুবকর এর লালন অসুরের সুরলোকযাত্রা
- শাস্ত্রীয় সঙ্গীত
- ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত সূচি
- হিন্দুস্থানী সঙ্গীত | শাস্ত্রীয় সঙ্গীত
- রাগ | সঙ্গীতের রাগ সূচি
আশা করি এই লেখাটি শিক্ষার্থীদের সঙ্গীত বিষয়ক প্রাথমিক ধারনা পেতে সাহায্য করবে। এরপর আমরা সঙ্গীতের ইতিহাস বিবর্তন সহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করবো।
লেখক:
প্রমুখ, গুরুকুল
উপদেষ্টা, সঙ্গীত গুরুকুল
আরও পড়তে পারেন :
12 thoughts on “সঙ্গীত কি? [ What is Music ]”