শিল্পী দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় । ভারতীয় সুরকার ও গায়ক

শিল্পী দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় ছিলেন একজন ভারতীয় সুরকার ও গায়ক, যাঁর সংগীতজীবন ছয় দশক ধরে বিস্তৃত। তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীত, বাংলা মৌলিক গান এবং বাংলা ও হিন্দি চলচ্চিত্রের গানের দক্ষ শিল্পী ছিলেন। সংগীতে তাঁর ব্যাপ্তি তাঁকে ২০১০ সালে এনে দিয়েছিল পদ্মভূষণ পুরষ্কার। পরের বছর বঙ্গবিভূষণ সম্মানে ভূষিত হয়েছিলেন তিনি। ছয় দশকের বেশি সময় বাংলা গান ও রবীন্দ্রসংগীতের জগতে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়।

শিল্পী দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় । ভারতীয় সুরকার ও গায়ক

প্রারম্ভিক জীবন

শিল্পী দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় ১৯২৭ সালের ১২ নভেম্বর জন্ম নিয়েছিলেন । তাঁর গানের গলার সঙ্গে অনেকেই হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মিল খুঁজে পান। তাঁর গলায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান অন্য মাত্রায় পৌঁছে যেত। এমনকী ছয়ের দশকে একাধিক ছবিতেও রবীন্দ্রসংগীত গেয়েছেন তিনি। তাঁর সঙ্গে সলীল চৌধুরির বন্ধুত্ব ছিল দীর্ঘদিনের। চল্লিশের শেষের দিকে একসঙ্গে অনেক গানও উপহার দিয়েছেন তাঁরা। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘রেখো মা দেশেরে মনে’, ‘একদিন ফিরে যাব চলে’। এর পাশাপাশি ‘জাগো দুর্গা’ গেয়ে জনপ্রিয়তার শিখর ছুঁয়েছিলেন শিল্পী। এপার বাংলার মতো ওপার বাংলাতেও তাঁর গান নিয়ে চর্চা হয়। তিনি নিজেও বাংলাদেশ গিয়েছেন একাধিকবার।

সঙ্গীত জীবন

পেশাদার গায়ক হিসেবে দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের ক্যারিয়ার শুরু হয় ১৯৪৪ সালে। মেগাফোন রেকর্ড কোম্পানি থেকে প্রথম গান রেকর্ড করেন ১৯৪৫ সালে। প্রায় দেড় হাজার গান তিনি রেকর্ড করেছেন। এর মধ্যে রবীন্দ্রসংগীত ৮০০। কিংবদন্তি সংগীতব্যক্তিত্ব সলিল চৌধুরীর সঙ্গে জুটি বেঁধে একের পর এক অনবদ্য সৃষ্টি এবং গণনাট্য সংঘের হয়ে কাজ করেছেন তিনি। সুশান্ত লাহিড়ী, পঙ্কজ মল্লিক, শান্তিদেব ঘোষের মতো ব্যক্তিত্বদের সান্নিধ্য দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়কে পৌঁছে দেয় অন্য উচ্চতায়। রবীন্দ্রসংগীত তো বটেই, বাংলা গানের জগতেও তিনি বরাবরই ছিলেন অনন্য।

শিল্পী দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় । ভারতীয় সুরকার ও গায়ক

তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীতের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় এক গায়ক ছিলেন। তিনি নিষ্ঠার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের ভাষান্তর করেছিলেন, তারঁ গান শুনে বাংলাএবং এর বাইরের মানুষেরাও রবীন্দ্রসঙ্গীতের শ্রোতা হয়ে গিয়েছিল। তিনি প্রখ্যাত বাংলা ছায়াছবিতে রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়েছিলেন, এর মধ্যে ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ছোট গল্প ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ (১৯৬০)। এছাড়া ‘সন্ধ্যা রাগ’ (১৯৭৭) ছবির জন্যেও তিনি গান গেয়েছিলেন। দুটি ছবির সঙ্গীত পরিচালনা করেছিলেন যথাক্রমে বিশিষ্ট সংগীত পরিচালক ওস্তাদ আলী আকবর খাঁ এবং পণ্ডিত রবিশঙ্কর।

শিল্পী দ্বিজেন ‘মহিষাসুর মর্দিনী’ (দানবের ধ্বংস) সঙ্গীতনাটকের অংশ হিসাবে বিখ্যাত ভক্তিমূলক গান ‘জাগো দুর্গা’ পরিবেশন করেছিলেন। এটি আকাশবাণী (অল ইন্ডিয়া রেডিও) (এআইআর), কলকাতা দ্বারা প্রচারিত একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় বেতার অনুষ্ঠান। প্রতি বছর ‘মহালয়া’র শুভ দিনে বিখ্যাত শারদীয় উৎসব ‘দুর্গাপূজা’র সূচনা উপলক্ষে এই অনুষ্ঠানটি প্রচার করা হয়। গত ৬০ বছর ধরে অসাধারণ জনপ্রিয়তার সাথে, এটি সমগ্র পৃথিবীতে, বাংলাভাষাভাষী সম্প্রদায়ের পরিচায়ক সুর হিসেবে স্বীকৃত এবং ভোর ৪টেতে জেগে উঠে বাঙালি দেবী দুর্গাকে এই চণ্ডীপাঠের মাধ্যমে স্বাগত জানায়।

তিনি অন্যদের মধ্যে, মার্শাল জোসিপ ব্রজ টিটো (যুগোস্লাভিয়ার রাষ্ট্রপতি), সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ (ভারতের রাষ্ট্রপতি), পণ্ডিত জওহরলাল নেহ্‌রু (ভারতের প্রধানমন্ত্রী), ইন্দিরা গান্ধী (ভারতের প্রধানমন্ত্রী) প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সামনে গান গেয়েছিলেন। ‘ভারতীয় সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি’র সদস্য হিসাবে তিনি সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং পূর্ব ইউরোপীয় দেশসমূহ যেমন পোল্যান্ড, রোমানিয়া, চেকোস্লোভাকিয়া, বুলগেরিয়া, এবং যুগোস্লাভিয়া সফর করেছিলেন।

শিল্পী দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় । ভারতীয় সুরকার ও গায়ক

পুরস্কার

২০১০ সালে ‘পদ্মভূষণ’ সম্মানে সম্মানিত করা হয় দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়কে। ২০১১ সালে তাঁকে দেওয়া হয় ‘বঙ্গবিভূষণ’। এ ছাড়া সাত দশকের বেশি সময়ের সংগীতজীবনে তিনি পেয়েছেন দেবব্রত বিশ্বাস মেমোরিয়াল পুরস্কার (১৯৮২), ইন্দিরা গান্ধী পুরস্কার (১৯৯১), রাজীব গান্ধী পুরস্কার (১৯৯২), উত্তম কুমার জীবনকৃতী সম্মানসহ (২০০২) আরও নানা সম্মাননা। ২০১০ সালে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি-লিট পান তিনি।

মৃত্যু

দীর্ঘদিন বার্ধক্যজনিত কারণে  ২০১৮ সালের ২৪ ডিসেম্বর কলকাতার বাড়িতে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৯১ বছর। তাঁর মৃত্যুতে শোকাহত বাংলার শিল্পীমহল।

আরও দেখুনঃ

1 thought on “শিল্পী দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় । ভারতীয় সুরকার ও গায়ক”

Leave a Comment