পাঁচালি গান : কবিগান পরিবেশন কালের প্রায় অর্ধেকটা অংশ জুড়েই কবিয়ালগণ পয়ার, ত্রিপদী প্রভৃতি ছন্দবন্ধে তর্কবিতর্ক করে থাকেন। ছন্দিত এই বিতর্কের অপর নাম পাঁচালি গান। উনিশ শতকে ‘পাচালি’ নামে আলাদা এক ধরনের গান ছিলো। ধুয়া গানের মতো গান এবং ছড়ার মাধ্যমে তখন কাহিনি বর্ণনা করা হতো। সে সময়ে দাশরথি রায়ের পাঁচালি এর উদাহরণ।
কবিগানের পাঁচালি নামের অংশটি উনিশ শতকের ঐ ‘পাঁচালি গান’ থেকে প্রভাবিত হওয়া সম্ভব। উদ্ভব যাই হোক ঊনিশ শতকের পাঁচালি গান এবং কবিগানের পাঁচালি এক নয়। কবিগানের পাঁচালির জনপ্রিয় প্রতিশব্দ ‘পাল্লা’ বা ‘কবির পাল্লা’। কোথাও কোথাও এই অংশ ‘আলোচনা’ নামেও অভিহিত হয়ে থাকে। আবার অনেকে এই অংশকে ‘পাঁচালি গান’ এর বদলে ছড়াকাটা নামে চিহ্নিত করে থাকেন।
টপ্পা গানের মাধ্যমে কবিয়ালগণ তাঁদের চরিত্র ও বিতর্কের বিষয় ঠিক করে নেওয়ার পর থেকেই শুরু হয় এই ছন্দিত পাঁচালি গানের পাঁচালি আলোচনা বা তর্কবিতর্কের পরম্পরা অক্ষুণ্ণ রেখে পাঁচালিকে অধিকতর আকর্ষণীয় করে তুলতে মাঝে মাঝে ডাক-ধুয়া (দিশা) বা ধুয়া গান পরিবেশিত হয়। এভাবে কবিগানের পাঁচালি অংশের সঙ্গে টপ্পা ও ধুয়া গান অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত হয়ে থাকে।
বস্তুত টপ্পাকে বিবেচনা করা যেতে পারে পাঁচালি গানের ভূমিকা হিসেবে, একইভাবে ধুয়া গানকে বিবেচনা করা যায় পাঁচালির অলঙ্কার হিসেবে। ছন্দের বিচারে পাঁচালি অংশকে অন্তত তিন ভাগে বিভাগ করা চলে, যথা: পয়ার পাঁচালি, ত্রিপদী পাঁচালি, এবং চৌপদী পাচালি। এগুলোর আবার বহু ধরনের রকমফের রয়েছে। যেমন পয়ারের রকমফের: লঘু পয়ার, দীর্ঘ পয়ার; ত্রিপদীর রকমফের: লঘু ত্রিপদী, দীর্ঘ ত্রিপদী, ভগ্ন ত্রিপদী; এবং চৌপদীর রকমফের: চৌপদী ও ভগ্ন চৌপদী।
পয়ার বাংলার জনপ্রিয় একটি ছন্দ। তবে আপাতদৃষ্টে পয়ারকে খুব সহজ ছন্দ মনে হলেও খুব অল্প পরিসরে উক্তি সম্পূর্ণ করতে হয় বলে, পয়ারের বন্ধনে বক্তব্যকে যথাযথভাবে উপস্থাপন করা খুবই কঠিন কাজ। দীর্ঘ পয়ারে কিছুটা স্বাধীনতা হয়তো থাকে, কিন্তু লঘু পয়ারের আঁটসাঁট বন্ধনে বক্তব্য উপস্থাপন করা, এবং একই সঙ্গে ঢোলের তালের সঙ্গে মিলিয়ে মিলিয়ে শব্দচয়ন করা অত্যন্ত কঠিন।
সাধারণত বক্তব্যের শেষ দিকে কবিয়ালগণ পয়ার ব্যবহার করে থাকেন। ঢোলের দ্রুত টোকার সঙ্গে মিলিয়ে কবিয়ালগণ যখন এই ছন্দে কথা বলেন, তখন তাঁদের দক্ষতা ও সৃজনশীলতা শ্রোতাদের বিস্মিত না করে পারে না।
পাঁচালি গান : একটি লঘু পয়ারের উদাহরণ :
যাক তবে বেশি বলে নাহি প্রয়োজন।
অল্পে অল্পে আসর আমি করি সমাপন ॥
কী বলিব নন্দী তোরে আমার কথা নিস।
কোনো দিন না শুনিবি কারো পরামিশ ॥
নারদের মতো ধূর্ত নাহি এ ত্রিলোকে।
পথভ্রষ্ট করিবারে চাহিয়াছে তোকে ॥
আমার দোষত্রুটি তোরে দেখাইতে চায়।
যাতে তোর গুরুভক্তি নষ্ট হয়ে যায় ॥
কবিগানের পরিভাষায় ত্রিপদী পাঁচালি গানের একটি জনপ্রিয় প্রতিশব্দ ‘ডাক-ছড়া’। কবিয়ালগণ এই ধরনের ছড়া কাটতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। যদিও এ কথা ঠিক যে ত্রিপদীর জটিলতা পয়ারের থেকে কিছুটা বেশি। সেখানে প্রতিটি চরণ একাধিক উপচরণে বিভক্ত থাকে, সেই উপচরণের প্রত্যেকটির দৈর্ঘ্য সমান হতে হয়, সর্বোপরি রক্ষা করতে হয় মধ্যমিল।
তাৎক্ষণিকভাবে কবিয়ালদের রচিত ত্রিপদী কেমন হয়, তা বোঝাতে একটি লঘু ত্রিপদী, একটি দীর্ঘ ত্রিপদী এবং একটি ভগ্ন ত্রিপদীর উদাহরণ পর্যায়ক্রমে তুলে ধরা হলো।
পাঁচালি গান : লঘু ত্রিপদী–
কমলদাস বৈরাগী কৃষ্ণপ্রেমে অনুরাগী মনে বাঞ্ছা যাবে বৃন্দাবন।
কালামৃধায় জন্মস্থান কৃষ্ণ বলে কাঁদে প্রাণ বৃন্দাবনে চলেছে যখন ॥
কলিকাতা পৌঁছাইতে ওড়াকান্দি পড়ে বিলের ভিতর দিয়া চলে।
বেলা প্রায় দ্বিপ্রহর হঠাৎ পড়ে নজর আলের উপর কিবা জ্বলে ॥
পাঁচালি গান : দীর্ঘ ত্রিপদী –
আবার বললে দেখতে পাই খাদ্যাদিতে বিচার নাই নির্বিচারে মতুয়া সব খায়।
এ কথা মোটে সত্য নয় সকল কিছু খাওয়া কি যায় খড় কুটা ঘাস খায় না মতুয়ায় ॥
ভালো করে আছে জানা মতুয়ারা বিষও খায় না তবে দোষ দাও অকারণ।
বলতে পারো মাছ মাংস খায় এগুলি তো অখাদ্য নয় সারা বিশ্বে ইহার সমর্থন ॥
ভগ্ন ত্রিপদী – দাদু তুমি আমার কথা নিও।
এই কলঙ্কের কথা শুনে কতো ব্যথা মায়ের প্রাণে ইহার সঠিক জবাব আমায় দিও ॥
মুখে তুমি যা করো বর্ণনা। একি কর্ম তোমার হলো। যা বলো তার উলটা চলো তোমার পক্ষে ইহা সম্ভবে না ।
কিছু কিছু ধুয়া গানে চৌপদী ছন্দের অন্তরা থাকে। তখন সেই ধুয়া গানকে অনুসরণ করতে গিয়ে কবিয়ালকে চৌপদী ছন্দের ছড়া কাটতে হয়। এই ধরনের একটি চৌপদীর উদাহরণ:
বন্দনার কথা দিলেম ছেড়ে পাল্লার কথা নিলেম ধরে জিজ্ঞাস করি শ্রীরামেরে জানিতে মনের বাসনা।
যজ্ঞ করো কী কারণে মা সীতা আজ নাই গো কেনে আমি চিন্তা করে হনুমানে নিজ জ্ঞানে কিছুই বুঝি না ॥ ১৯
পাঁচালিগানের মধ্যে কখনো কখনো গদ্যের দেখা পাওয়া যায়। যুক্তির খাতিরে অনেক কবিয়াল ছোটো আকারের হাস্যরসাত্মক গল্প বা চুটকি গল্পের আশ্রয় নিয়ে থাকেন। এইসব গল্পের অনেকগুলো ছন্দিত আকারে উপস্থাপিত হলেও ছোটো আকারের অনেক গল্প কবিয়ালগণ গদ্যে বর্ণনা করে থাকেন।
উল্লেখিত পাঁচালি গানের সেই গদ্যও বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে উপস্থাপিত হওয়ায় সাধারণ গদ্যবাক্যের থেকে তা আলাদা হয়ে থাকে। পাঁচালির মধ্যে পরিবেশিত এই ধরনের গদ্যকে তুলনা করা যায় গদ্যকবিতার সঙ্গে, অথবা একে বলা চলে এক ধরনের ছন্দিত গদ্য। এই গদ্যে সাধারণত হাস্যরসাত্মক কাহিনি বর্ণিত হওয়ায়, সাধারণ শ্রোতাগণ প্রায়ই ভুলে থাকেন যে, পাঁচালির এই বিশেষ অংশটি ছন্দমিল ছাড়াই উপস্থাপিত হলো।
[ রেফারেন্স : ১৯ পাঁচালির পাঁচটি উদাহরণের মধ্যে প্রথম চারটি বাগেরহাটের স্বরূপেন্দু সরকারের পাঁচালি থেকে নেওয়া, যা এই বইয়ের পরিশিষ্ট থেকে গ্রহণ করা হয়েছে। পঞ্চমটি নেত্রকোনার মদন সরকারের, যা যতীন সরকারের ‘বাংলাদেশের কবিগান’ গ্রন্থে উদ্ধৃত। যতীন সরকার, বাংলাদেশের কবিগান (ঢাকা: বাংলা একাডেমী, ১৯৮৫), পৃ. ৩৭-৩৮।]
লেখক :
স্বরোচিষ সরকার [ Shorochish Sarkar]
বিশিষ্ট আভিধানিক ও বৈয়াকরণ
অধ্যাপক, ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ।
লেখক : কবিগানের স্বরূপ ও প্রকৃতি
এই বিষয়ে অন্য গুরুত্বপূর্ণ আর্টিকেলগুলো দেখুন :
এ বিষয়ে অন্যান্য লিংক:
- উইকিপিডিয়া : কবিগান
14 thoughts on “পাঁচালি গান [ Panchali Gaan – Kavigan, Kobi Gaan, Kobi Lorai or Kabigan ] স্বরোচিষ সরকার”