ধামার গান । গীত ধারা । হিন্দুস্থানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীত

ধামার গান বা এক শব্দে ধামার ধামার হিন্দুস্থানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীত এর একটি গীত ধারা। এই গীত রীতির প্রচলন কে কবে করেছেন তা আজও সঠিক ভাবে জানা যায় নি। তবে অনেকে মনে করেন স্বামী হরিদাস এই গানের সৃষ্টি করেন। তবে এর কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় নি। এই গানের চারটি তুক্ বা বিভাগ থাকে। – স্হায়ী, অন্তরা, সঞ্চারী ও আভোগ। এই গানের ভাষা সাধারণত ‘রাধাকৃষ্ণের’ প্রেম বিষয়ক। এই গান গাওয়ার পূর্বে নোম, তোম,রি, রে, না ইত্যাদি বাণী দ্বারা আলাপ গাওয়া হয় এবং বিভিন্ন লয়কারীতে গাওয়া হয়। তবে এই গানের মূল বৈশিষ্ট্য হল তালের নামে ই গানের নাম করন। অর্থাৎ এই গানে ‘ধামার’ তাল ব্যবহার করা হয়। এছাড়া অন্য কোনো তাল ব্যবহার করা হয় না। তালবাদ্য হিসেবে পাখোয়াজ ব্যবহার করা হয়।

ধামার গান । গীত ধারা । হিন্দুস্থানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীত

ধামার গান । গীত ধারা । হিন্দুস্থানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীত

 

ধামার ভারতীয় উপমহাদেশের হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে ব্যবহৃত তালগুলির মধ্যে একটিও বটে। এটি ধ্রুপদ শৈলীর সাথে যুক্ত এবং সাধারণত পাখাওয়াজ এবং তবলায় বাজানো হয়। এই তালে ১৪টি বীট রয়েছে যা একটি ৫-২-৩-৪ প্যাটার্নে অসমমিতভাবে গোষ্ঠীবদ্ধ।

ধামার । গীত ধারা । হিন্দুস্থানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীত

এটা একটিঅতি প্রাচীন গীতি রীতি। এই গীতি রীতি যন্ত্রসঙ্গীতেও প্রয়োগ করা হয়। ধ্রুপদের সাথেসএই গায়ন রীতির এর অনেক মিল রয়েছে। প্রধান পার্থক্য হল যে এই গীতি রীতিটি একটু বেশি রোমান্টিক। এই গীতির থিমগুলি সাধারণত কৃষ্ণ এবং হোলি উৎসবকে ঘিরে আবর্তিত হয়। তবে এই গীতিরীতিকে প্রায়ই “হোরি” (হোলি) বলা হয়।

ধামার । গীত ধারা । হিন্দুস্থানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীত

ধামারশৈলীর গান কে প্রবর্তন করেন বা কবে থেকে এই গীতশৈলীর উদ্ভব ও প্রচলন হয় আজ অবধি তা জানা যায়নি। অনেক সংগীতগুণীজনের ধারণা, পঞ্চদশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ সংগীত দিকপাল স্বামী হরিদাসজির কল্পনা থেকেই ধামারশৈলীর গান রূপ লাভ করেছে।

তৎকালীন সময়ে সংগীত সংস্কারের সুমহান দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে বৃন্দাবনের বাঁকেবিহারির মন্দিরে সাধন-ভজন করেই তিনি সারাটি জীবন অতিবাহিত করেন। ব্রজভাষায় তিনি ধ্রুপদাঙ্গের কিছু কিছু পদ রচনা করেছিলেন। ধর্ম প্রচারের প্রয়োজনে বৃন্দাবনে তিনি ‘রাসের পদ’ গানের প্রচলন করেন। ধারণা করা হয়, মার্জিত ব্রজভাষায় রাধা-কৃষ্ণের প্রেমবিষয়ক বর্ণনা সমন্বিত গাম্ভীর্যবিহীন যে সুরের মূর্ছনা ভক্তদের হৃদয়কে সিক্ত করে তাকেই বলে ‘ধামার’ গান।

উক্ত বিষয়টি নিয়ে মতভেদ থাকলেও সংগীতজ্ঞ গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায় ধামার গানের নামকরণ নিয়ে যে বিশেষ আলোকপাত করেছেন তা নিয়ে অনেকেই একমত হয়েছেন। তাঁর ভাবনা ও বর্ণনানুসারে ‘ধর্ম’ শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘কৃষ্ণ’ এবং ‘আর’ শব্দের প্রতিশব্দ হলো ‘রীতি বা নিয়ম’। স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বৃন্দাবনে হোলি উৎসবে যে ছন্দ তথা রীতিতে গান করতেন সেই গীত পদ্ধতিকে অনুসরণ করে পরবর্তীকালে প্রচলিত গীতশৈলীকে বলা হয়ে থাকে ধামার গান।

সাধারণভাবেই হিন্দি, উর্দু ও ব্রজভাষায় রচিত ‘রাধা-কৃষ্ণের’ লীলাবিষয়ক বর্ণনা এবং কৃষ্ণচরিত্র ও বৃন্দাবনের বর্ণনাই হচ্ছে ধামার গানের বিষয়বস্তু। এই শৈলীর গানে চৌদ্দমাত্রার বিষমপদী নির্দিষ্ট ‘ধামার’ তাল ব্যতীত অন্য কোনো তাল ব্যবহৃত হয় না।

ধামার গানের ৪ (চার)টি তুক বা বিভাগ থাকে। সেগুলো হচ্ছে – স্থায়ী, অন্তরা, সঞ্চারী ও আভোগ। তবে স্থায়ী ও অন্তরা এ দুটি তুকের ধামার গান বর্তমানে বেশি প্রচলিত। শৃঙ্গার রসাত্মক এবং ধ্রুপদ অপেক্ষা লঘু হলেও চৌদ্দমাত্রাযুক্ত বিষমপদী তালে নিবদ্ধ এই গান গাওয়া অত্যন্ত কষ্টসাধ্য ব্যাপার।

এই শৈলীর গানে যেভাবে দুগুণ, তিনগুণ, চৌগুণ, আড়, কুআড়, বিআড় ইত্যাদি লয়কারীতে বাট করতে হয়, তা কঠোর অনুশীলন ও বহু সাধনা ছাড়া অর্জন করা সম্ভব নয়।

ধামার গান গাওয়ার পূর্বে নোম-তোম ইত্যাদি বাণীর সহযোগে রাগভিত্তিক আলাপচারী করা হয়ে থাকে। এই শৈলীর গানে তান করা না হলেও নানান ছন্দের বোলতান প্রয়োগ একজন শিল্পীর দক্ষতা ও নৈপুণ্যের পরিচয় বহন করে।

আগের দিনের সংগীতগুণীজনেরা ধ্রুপদ গান গাওয়ার পর অপেক্ষাকৃত চঞ্চল প্রকৃতির ধামার গান পরিবেশন করতেন। কেউ কেউ এই শৈলীর গানকে হোরি বা হোলি গান বলে থাকেন, যা যুক্তিসংগত নয় বলেই অনেক সংগীতগুণীজনের ধারণা। তাঁদের মতে, হোরি বা হোলি নামে ভিন্ন শৈলীর আরো এক প্রকার গান প্রচলিত রয়েছে, যা ধামার হতে গুণগতভাবে ভিন্ন প্রকৃতির।

জনপ্রিয় একটি ধামার গান উদাহরণস্বরূপ প্রদান করা হলো –

কানা রাঙা ডারা দিও
মোবারা স্বাস মোরি
শুনেকো দেগি গারি ॥

ম্যায় তুমকো না জানাতা
সুয়ামি সুনে মোহে
মাড়হে আনাড়ি ৷৷

[ঠাট : ভৈরবী, রাগ : মালকোষ, বাদীস্বর : মধ্যম (ম), সমবাদীস্বর : ষড়জ (স), অঙ্গ উত্তরাঙ্গ প্রধান, জাতি : ঔড়ব-ঔড়ব, গায়ন সময় : রাত্রি তৃতীয় প্রহর, আরোহণ : ণ্ স জ্ঞ ম দ ণ র্স, অবরোহণ : র্স ণ দ ম জ্ঞ ম জ্ঞ স, তাল : ধামার (১৪ মাত্রা)। বি.দ্র. স্থায়ীর দ্বিগুণ পাচ (৫) মাত্রার পর থেকে ডারা বলে এবং অন্তরার দ্বিগুণ আট (৮) মাত্রা থেকে তুমাকো বলা হয়।]

 

 

আরও দেখুন:

Leave a Comment