দিলীপ বাগচী । বাঙালি কমিউনিস্ট রাজনীতিবিদ ও গণসঙ্গীত শিল্পী

দিলীপ বাগচী একজন বাঙালি কমিউনিস্ট রাজনীতিবিদ ও গণসঙ্গীত শিল্পী।

দিলীপ বাগচী । বাঙালি কমিউনিস্ট রাজনীতিবিদ ও গণসঙ্গীত শিল্পী

প্রারম্ভিক জীবন

দিলীপ বাগচীর জন্ম বাংলাদেশের পাবনা জেলায়। পিতা যুগান্তর বিপ্লবী দলে যুক্ত ছিলেন এবং স্বদেশী আন্দোলনের সময় একবার কারাবাস করতে হয়। দাদা ব্রিটিশবিরোধী নৌ – বিদ্রোহে যোগদান করে গ্রেপ্তার হন। দেশভাগের পর প্রথমে বাঁকুড়া ও পরে হাওড়া আসেন। হাওড়া জেলা স্কুলে পড়ার সময়ে হেমাঙ্গ বিশ্বাসের গান শুনে গণসঙ্গীতে আগ্রহ জন্মে। এই স্কুলে তার সহপাঠী ছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। তার অভিনীত স্কুলের সমস্ত নাটকে মূল গায়ক ছিলেন দিলীপ বাগচী।

ছাত্র ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন

১৯৫১ সালে ছাত্রাবস্থাতেই ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। কমিউনিস্ট রাজনীতির সংগে যোগাযোগ রাখার অপরাধে স্কুল থেকে বহিষ্কার করে কর্তৃপক্ষ। রাজনৈতিক প্রচারকার্য করার সময় স্বরচিত গান গাইতেন, এভাবেই রচিত হয়েছে বহু গণসঙ্গীত যা তৎকালীন পার্টিকর্মী ও সাধারণ মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়েছিল। হাওড়া নরসিংহ দত্ত কলেজে পড়ার সময় ভারতীয় গণনাট্য সংঘের সদস্য হন এবং ট্রামভাড়া বৃদ্ধি বিরোধী আন্দোলনে যোগদান করে পুলিশের গুলিতে মারাত্মক ভাবে আহত হয়েছিলেন। কৃষ্ণনগর সরকারি কলেজ এ ভর্তি হয়ে গননাট্য নদীয়া জেলা শাখার সাথে যুক্ত হন। ছাত্র ও সাংস্কৃতিক ফ্রন্টে একইসাথে কাজ করতেন।

দিলীপ বাগচী । বাঙালি কমিউনিস্ট রাজনীতিবিদ ও গণসঙ্গীত শিল্পী

১৯৫৬ সালের প্রবল বন্যায় হারমোনিয়াম নিয়ে গানের দলের সাথে গ্রামে গঞ্জে বন্যাদুর্গতদের সাহায্যার্থে গান গেয়েছেন দিনের পর দিন। পরের বছর দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির বিরুদ্ধে কৃষক আন্দোলনে অংশগ্রহণ। পরিবার থেকে তাকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখার জন্যে বোম্বেতে পড়াশোনার জন্যে পাঠালে সেখানে সলিল চৌধুরী, রুমা গুহঠাকুরতা, বাসু ভট্টাচার্য ও বোম্বের সংগীতজগতের ব্যতিক্রমী মানুষের সাথে যোগাযোগ হয়। পরবর্তীতে হেমাঙ্গ বিশ্বাসের সাথেও আলাপ গড়ে ওঠে গানের সূত্রে। দিল্লীতে সারা ভারত গণনাট্য সংঘের সম্মেলনে প্রতিনিধিত্ব করেন। থিতু হয়ে কোথাও থাকেননি ফলত প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা বারবার ব্যাহত হয়েছে। যেখানে গেছেন যেখানকার আঞ্চলিক ভাষা, সুর, প্রকৃতি নিয়ে গান বাঁধার অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল তার।

১৯৫৭ সালে পার্টি কংগ্রেসে গ্রামে গিয়ে কাজ করার পরামর্শ দেওয়া হয়। ১৯৫৯ সালে নদীয়া মুর্শিদাবাদ জেলায় পার্টির সর্বক্ষনের কর্মী হিসেবে কাজ করতে করতে আবার শিক্ষকতার কাজে যোগ দিয়েছেন। এসময় হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে স্কুলে এক পংক্তিতে ছাত্রদের খাইয়ে সমাজপতিদের বিরাগভাজন হন। মুর্শিদাবাদের টুঙ্গী গ্রামের ইউনিয়ন বোর্ডের ভোটে সাহসিকতার সাথে স্বচ্ছ নির্বাচনের দায়িত্ব নেন। কৃষক সভার সদস্যদের সাথে প্রতিরোধ করেন তদানীন্তন শাসকদলের গুন্ডা ও ভাড়াটে লেঠেলবাহিনীর। এর ফলে তাকে প্রানে মারার চক্রান্তও হয়।

১৯৬২ সালে ভারত-চীন সীমান্ত সংঘর্ষের সময় ভারতরক্ষা আইনে গ্রেপ্তার হয়ে বহরমপুর জেলে প্রেরিত হন। এসময় কারাকক্ষের ভেতরেও গান রচনা করেছেন এই চারণ কবি। জেল থেকে বি.এ পরীক্ষা দিতে চাইলে তা কারাকর্তৃপক্ষ মঞ্জুর করেনি।

১৯৬৪ সালে পার্টি কংগ্রেসের আগেই গোপন বলশেভিক কোর গঠন করেন স্বদেশ মিত্র, ডালিম চক্রবর্তী, বিমল করগুপ্তদের সাথে, যাতে করে সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে বিপ্লবী পার্টি গঠন ও সশস্ত্র সংগ্রামের প্রথম আহবান জানানো হয়। এই বেনামী দলিলটি বিপ্লবী সূর্য সেনের নামে ছাপা হয়েছিল। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে এম.এ’র ছাত্র হিসেবে ভর্তি হন ও জনপ্রিয় গায়ক হওয়ার সুবাদে ছাত্র রাজনীতিতে পরিচিত হয়ে ওঠেন দিলীপ বাগচী। তিনি সাংস্কৃতিক সম্পাদক এবং সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। এসময় তাদের ‘সূর্য সেন দলিল’ নিয়ে শিলিগুড়ির কমিউনিস্ট নেতৃত্বের সাথে কথাবার্তা হয় ও পরে চারু মজুমদারের বাড়িতে তার সাথে সাক্ষাত হলে তিনি এই দলিলকে নাকচ করেন।

দিলীপ বাগচী । বাঙালি কমিউনিস্ট রাজনীতিবিদ ও গণসঙ্গীত শিল্পী

নকশাল আন্দোলন

১৯৬৭ সালে নকশালবাড়ী হত্যাকান্ডের দিনই বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ও নকশাল, নকশাল, নকশালবাড়ীর মা’ গানটি রচনা করেন। এটি আঞ্চলিক রাজবংশী ভাষায় মৈষাল সুরে গাওয়া। নকশাল আন্দোলনের প্রেক্ষিতে লেখা এটিই প্রথম গান যা বিপ্লবী কর্মীদের ভেতর অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিল।২২ আগস্ট শিলিগুড়িতে তার ও অন্যান্য ছাত্রনেতাদের প্রচেষ্টায় এক বিরাট জনসভা হয় যেখানে নকশালবাড়ী কৃষক সংগ্রামের পক্ষে বক্তব্য রাখেন প্রখ্যাত অভিনেতা ও নাট্যকার উৎপল দত্ত। এই ঘটনার পরপরই ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী) থেকে চারু মজুমদার, সৌরেন বসু, মহাদেব মুখার্জীর সাথে একই দিনে বহিষ্কৃত হন দিলীপ বাগচী।

আত্মগোপন করা অবস্থায় মুর্শিদাবাদ থেকে ধরা পড়েন পুলিশের হাতে ১৯৬৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর। তার বিরুদ্ধে ২১ টি মামলা দায়ের করা হয়েছিল। তার গ্রেপ্তারির বিরুদ্ধে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা পরীক্ষা বর্জন করে। শিলিগুড়ি স্পেশাল জেলে তাকে রাখা হয় বিপ্লবী নেতা জঙ্গল সাঁওতাল, পবিত্রপানি সাহা প্রমুখদের সাথে। দার্জিলিং জেলে রাজনৈতিক বন্দীর মর্যাদার দাবীতে অনশন করেন। স্লোগান দেওয়ার কারণে পুলিশের অত্যাচারে সংজ্ঞা হারান। তাকে দমদম সেন্ট্রাল জেলে স্থানান্তর করা হয়।

১৯৬৯ সালে মুক্তি পেলেও রাজনৈতিক কারণে তাকে স্কুলের চাকরি থেকে বঞ্চিত করা হয়, আদালতের রায়ে পূনর্বহাল হন। বহু স্কুলে শিক্ষকতার কাজ করেছেন, পরীক্ষা ব্যবস্থা সংশোধন ও বিনা ট্যুইশন ফি’তে পড়ানোর দাবীতে আন্দোলন করেছেন। জরুরী অবস্থার পরে কৃষক- মজদুর সমিতি গঠন, বন্দী মুক্তি আন্দোলন, মানবাধিকার আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন আমৃত্যু।

দিলীপ বাগচী । বাঙালি কমিউনিস্ট রাজনীতিবিদ ও গণসঙ্গীত শিল্পী

লেখা

তার লেখা অজস্র গান আছে যা সংগ্রহ করা যায়নি। ‘তরাই এর গান’ নামক একটি ক্যাসেট সংকলন সোদপুরের ‘নিশান্তিকা গোষ্ঠী’ বের করে। অসংখ্য প্যারোডি, ছড়া, শিক্ষা ও গণসংগীত বিষয়ক প্রবন্ধ এবং কিছু ছোটগল্প লিখেছেন বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনে। সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তার ‘বুকের পাথর’ উপন্যাসে একাধিকবার দিলীপ বাগচীর সশ্রদ্ধ নামোল্লেখ করেছেন।

মৃত্যু

তার শেষ জীবন অর্থকষ্ট ও যন্ত্রনার মধ্যে কেটেছে। পরিবারকেও তার সম্মুখীন হতে হয়। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হতে হয়েছে চাকরি জীবনে বহুবার। প্রাপ্য টাকা পয়সা থেকে বঞ্চিত হয়ে নিতান্ত অবহেলায় মারা যান ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি।

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment