কীর্তন বা কীর্তন গান – সঙ্গীত শৈলী [ Kirtan, Music Genre ]

কীর্তন বা কীর্তন গান – সঙ্গীত শৈলী [ Kirtan, Music Genre ] ,কীর্তন [ Kirtan ] শব্দের অর্থ হচ্ছে গুণকথন। সাধারণভাবে ঈশ্বরের নাম, গুণ ও লীলাবিষয়ক পদ যখন সুর ও তালবদ্ধ হয়ে উচ্চকণ্ঠে গাওয়া হয় তখন তাকে বলা হয় কীর্তন। রাধা-কৃষ্ণের লীলা ও গৌরাঙ্গের জীবনগাথা অবলম্বনে রচিত কীর্তন বাঙালি সংস্কৃতির প্রাচীনত্বের দাবি রাখে।

এই গানের সঙ্গে সংগত করা তালগুলো হচ্ছে ছোট দশকোশী (৭ মাত্রা), মধ্যম দশকোশী (১৪ মাত্রা), বড় দশকোশী (২৮ মাত্রা), তেওট (১৪ মাত্রা), ছোট তেওট (৭ মাত্রা), দাসপেড়ে (৮ মাত্রা), দোঠুকি ( ১৪ মাত্রা), চঞ্চুপুট (৮ মাত্রা), ধীরা (৮ মাত্রা), লোফা (৬ মাত্রা), দোজ তাল (১২ মাত্রা), কাটাধরা (১৬ মাত্রা), মদন দোলা (২২ মাত্রা), ইন্দ্ৰভাব (২৬ মাত্রা), গঞ্জন (৩২ মাত্রা), বিষমপঞ্চম (৩২ মাত্রা), বীরবিক্রম (৩৫ মাত্রা), শশী শেখর (৪৪ মাত্রা) ইত্যাদি কীর্তন গানের সঙ্গে বাদ্যযন্ত্র হিসেবে খোল ও মন্দিরা বা করতাল ব্যবহার করা হয়। প্রধানত তিন প্রকারের কীর্তনের কথা জানা যায়। সেগুলো হচ্ছে নামকীর্তন, লীলাকীর্তন ও রসকীর্তন।

কৃষ্ণ চন্দ্র দে’র “জয় সীতা পতি” – মান্না দে গেয়েছেন:

কীর্তন বা কীর্তন গান – সঙ্গীত শৈলী [ Kirtan, Music Genre ]

নামকীর্তন [ Naam Kirtan :

নামকীর্তনের প্রধান উপজীব্য হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণের নামগান। তাই একে নাম সংকীর্তন, নামগান কিংবা নামাবলিও বলা হয়ে থাকে। নৃত্য হচ্ছে নামকীর্তন গানের অন্যতম অঙ্গ। অষ্টপ্রহর নামকীর্তনে সময়োচিত নানা রাগের অবতারণা করা হয়।

লীলাকীর্তন [ Leela Kirtan ] :

একটি অধ্যায়ের লীলাগানকে বা একই প্রকৃতির লীলাগানকে বলা হয় লীলাকীর্তন। আবার লীলার বিভিন্ন পদের একত্র সমাবেশে হয়ে থাকে পালাকীর্তন। পরবর্তী সময়ে গৌরাঙ্গলীলাকেও এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

রসকীর্তন [ Rosh Kirtan ] :

চৌষট্টি রসের অবতারণাসমৃদ্ধ গানকে বলা হয় রসকীর্তন। রাধা-কৃষ্ণের বৃন্দাবনলীলার বিভিন্ন অধ্যায়ে চৌষট্টি রসের পরিবেশ নিয়ে বৈষ্ণব সাহিত্য সমৃদ্ধ হয়েছে। রসকীর্তনে বিভিন্ন অধ্যায়ের একই প্রকার রস অথবা কখনো কখনো দু-তিনটি রসের একত্র সমাবেশ ঘটে। বিভিন্ন স্থান থেকে একই প্রকৃতির রস সন্নিবেশ দ্বারা একটি পূর্ণাঙ্গ গীতসাহিত্য সৃষ্টি করা হলে পালাকীর্তনের উদ্ভব হয়।

আবার লীলাকীর্তন কিংবা রসকীর্তন যখন বিভিন্ন পদকর্তার পদ নিয়ে একত্রে মালা গেঁথে গাওয়া হয় তখন তাকে পদাবলি কীর্তন বলে। আর যখন হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ ষোলোবার গাওয়া হয় তখন তাকে বলে ‘সংকীর্তন’। কীর্তনের পাঁচটি অঙ্গ হচ্ছে যথাক্রমে – কথা, দোহা, আখর, তুক ও ছুট।

কথা :

কীর্তনের ভাষা বা গানের বাণীকে বলা হয় কথা। কীর্তন পরিবেশনের সময় গানের কোনো অংশের অর্থ কীর্তনীয়া বা কীর্তন গায়ক বা কীর্তনশিল্পী যখন বুঝিয়ে দেন তখন তাকেও বলা হয় কথা ।

দোহা :

দোহা বলতে বোঝায় শ্লোকভঙ্গির রচনা, সেগুলো কীর্তন শিল্পীগণ আবৃত্তি করে থাকেন।

আখর :

কীর্তনের বিশেষ উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে আখর।

তুক :

অনুপ্রাসবহুল ও ছন্দময় মিলনাত্মক গাঁথা তুক নামে অভিহিত। কীর্তন শিল্পীগণ এসব তুক রচনা করে মূল গানের সঙ্গে যুক্ত করেন।

ছুট :

কীর্তনের তাল বা পদের অংশবিশেষকে ছুট বলে। কীর্তন পরিবেশনের সময় সম্পূর্ণ পদটি না গেয়ে পদের অংশবিশেষ ছোট তালে গাওয়া হলে তাকে ছুট বলা হয়ে থাকে।

এই পাঁচটি অঙ্গ ছাড়াও কীর্তন গানের আরেকটি অঙ্গ রয়েছে। যার নাম ঝুমুর। কীর্তন অঙ্গে ঝুমুর হচ্ছে এক প্রকার জমজমাট রচনা। আধুনিককালে ছয়টি পদ্ধতিতে কীর্তন গাওয়া হয়ে থাকে। সেগুলো পর্যায়ক্রমে বর্ণিত হলো –

প্রথম : হাতুটি (হাতটি) সঙ্গে আপাত্তন বা সুর মেল,

দ্বিতীয় : গৌরচন্দ্রিকা সঙ্গে আপাত্তন বা সুর মেল,

তৃতীয় : ঝুমরা (ঝুমুর) ও মাতান

চতুর্থ : গাছ বা মূলগানের সঙ্গে আখর, কাটান ও পর কাটান। অর্থাৎ শাখা-প্রশাখা

পঞ্চম : মিলন বা ঝুমরা (ঝুমুর) এবং

ষষ্ঠ : নামসংকীর্তন।

লীলাকীর্তন বা রসকীর্তন গাওয়ার ধারা [ Types of Leela and Rosh Kirtan ]

লীলাকীর্তন বা রসকীর্তন গাওয়ার প্রধান পাঁচটি ধারা প্রচলিত রয়েছে। সেগুলো হচ্ছে – গরানহাটি বা গড়েরহাটি, ঝাড়খণ্ডি, মনোহরশাহী, মন্দারিণী এবং রেনেটি বা রানীহাটি ।

গরানহাটি বা গড়েরহাটি :

শ্রী নরোত্তম দাস ঠাকুর প্রবর্তিত ধ্রুপদ অঙ্গের কীর্তনই গরানহাটি বা গড়েরহাটি ধারার কীর্তন গান নামে সুপরিচিত। পশ্চিমবঙ্গের গরানহাটি পরগনার খেতুরি উৎসবে এই ধারার কীর্তন প্রথম গাওয়া হয়, যা যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করে।

ঝাড়খণ্ডি :

রাঢ় অঞ্চলের লোকগীতির নাম হচ্ছে ঝুমুর। স্থানীয়দের কাছে অসম্ভব জনপ্রিয় এই ঝুমুর গানের সুরের অনুকরণে ঝাড়খণ্ডি ধারার কীর্তন সৃষ্টি করা হয়েছে।

মনোহরশাহী :

মনোহরশাহী পরগনার শ্রীনিবাস আচার্য কর্তৃক প্রবর্তিত ধারাটি মনোহরশাহী কীর্তন নামে পরিচিতি লাভ করেছে। এই কীর্তন ধারাতে অভিজাত গীতের অলংকরণ প্রয়োগের সঙ্গে সঙ্গে মনোহরশাহী পরগনার লোকসংগীতের সুরের ব্যবহার একে শ্রুতিনন্দন করে তুলেছে।

মন্দারিণী :

সরকার মন্দারণের মঙ্গলকাব্যের অনুসরণে সৃষ্ট কীর্তনকে মন্দারিণী ধারার কীর্তন বলে অভিহিত করা হয়।

রেনেটি বা রানীহাটি :

রানীহাটি পরগনার আচার্য শ্যামনন্দ কর্তৃক প্রবর্তিত কীর্তন রেনেটি বা রানীহাটি কীর্তন নামে পরিচয় লাভ করেছে। এই ধারার কীর্তনে সুরের কিছুটা চপলতা পরিলক্ষিত হয়।

খেতুরির মহোৎসব আরম্ভ হতেই বাংলাতে রীতিবদ্ধ কীর্তনের জয়যাত্রা শুরু হয়। মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য দেবের সময়কেই কীর্তন গানের ‘স্বর্ণযুগ’ বলে অভিহিত করা হয়। এ সময় প্রধানত বৈষ্ণব পদাবলিই ছিল কীর্তন গানের উপজীব্য । সংগীতের আধুনিককালে এসে অপর কয়েকটি গীতিরীতির সঙ্গে কীর্তন নামটি যুক্ত হয়ে তপকীর্তন, কালীকীর্তন ইত্যাদি নামে প্রকাশিত হলেও প্রকৃতপক্ষে সেগুলোকে কীর্তন বলা যায় না।

পদাবলি রচয়িতা এবং প্রসিদ্ধ বৈষ্ণব কবি শ্রী চণ্ডীদাসের বিখ্যাত একটি কীর্তন উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা হলো –

বঁধু কী আর বলিব আমি।

জীবনে মরণে জনমে জনমে প্রাণনাথ হয়ো,

তুমি প্ৰাণনাথ হয়ো ॥

এই মিনতি বঁধু আমার শুধু এই মিনতি

আমি ভাবিয়া দেখিনু প্রাণনাথ বিনে

কবে সে পরানে মরি ।।

বাঁচবে নাহে, তুমি বিনে প্রাণ বাঁচবে নাহে;

তুমি রাধার প্রাণকান্ত মণি, তুমি বিনে প্রাণ বাঁচবে নাহে।

সব সমপিয়া একমন হইয়া নিশ্চয় হইলাম দাসী।

দাসী হলেম, ঐ চরণ দাসী হলেম,

আমার যা ছিল সব সঁপে দিয়ে, ঐ চরণের দাসী হলেম

চণ্ডীদাস কহে পরশ রতন গলায় গাঁথিয়া পরি।

বঁধু গলায় গাঁথিয়া পরি ।।

[গীতিকার, সুরকার ও শিল্পী চণ্ডীদাস, তাল: একতাল (১২ মাত্রা তাল ফেরতা)

কীর্তন বা কীর্তন গান - সঙ্গীত শৈলী [ Kirtan, Music Genre ]
কীর্তন বা কীর্তন গান
আরও পড়ুন :

2 thoughts on “কীর্তন বা কীর্তন গান – সঙ্গীত শৈলী [ Kirtan, Music Genre ]”

Leave a Comment