কাওয়ালি বা কাওয়ালী গান কি? [ Qawwali, Music Genre ] সুফি ফারুক ইবনে আবুবকর

কাওয়ালী গান কি ,কাওয়ালি গান এক ধরনের ভক্তি-সংগীত। মহান আল্লাহ, রসুলুল্লাহ (সা:) বা পীর আউলিয়ার প্রশংসা সূচক কথা দিয়ে কাওয়ালি গান তৈরি হয়। কাওয়ালি মূলত ফারসি ও উর্দু ভাষায় রচিত হয়ে থাকে। তবে পাঞ্জাবী এবং বাংলা ভাষাতেও কাওয়ালী রচিত হয়েছে। মুসলমান সুফি ও সাধকবৃন্দের আধ্যাত্মিক ও ধর্মবিষয়ক বিভিন্ন কাহিনীই হচ্ছে এই গানের মূল বিষয়বস্তু।

কাওয়ালি বা কাওয়ালী গান কি? [ Qawwali, Music Genre ] সুফি ফারুক ইবনে আবুবকর
কাওয়ালি বা কাওয়ালী গান কি? [ Qawwali, Music Genre ] সুফি ফারুক ইবনে আবুবকর

“কাওয়ালী” অর্থাৎ “লি” এর জায়গায় “লী” দিয়ে যদিও কাওয়ালি গানের বানান সার্চ বেশি হয়, তবুও বইপত্রে বেশিরভাগ স্থানে শব্দটি “লি” দিয়ে অর্থাৎ কাওয়ালি হিসেবে লেখা থাকার করণে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমরাও তাই ব্যবহার করলাম।  খুঁজে পাবার সুবিধার্থে দু একটি জায়গায় কাওয়ালী রাখা হলো”

 

কাওয়ালি বা কাওয়ালী গান কি? [ Qawwali, Music Genre ]

শুরুতে কেবল মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যেই কাওয়ালি গান প্রচলিত এবং অভাবনীয় জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলো। এখনো বিভিন্ন পীর-কামেল এর রওজা, জন্ম-মৃত্যুবার্ষিকী, ওরসে নিয়মিত কাওয়ালির আয়োজন করা হয়। তবে নুসরাত ফাতেহ আলী খানের মাধ্যমে কাওয়ালি জনপ্রিয়তার এমন একটি উচ্চতা লাভ করেছে, এখন অন্যান্য যেকোনো উপলক্ষেই কাওয়ালির আয়োজন হয় এবং ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সবাই তা উপভোগ করে।

কথিত আছে, ‘কওল’ থেকে কাওয়ালি শব্দটির উৎপত্তি। বাংলাপিডিয়াতে বলা হয়েছে – দিল্লির পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের ‘কাওয়াল’ নামক একটি যাযাবর গোষ্ঠী ছিলো, যারা এক ধরণের ভক্তিমূলক গান গাইত, সেই গানের নাম ছিলো কাওয়ালি। বিভিন্ন সময়ের সংগীত-গবেষক ও গুণীজনদের গবেষণা  থেকে জানা যায়, ইতিহাসবিখ্যাত সংগীতজ্ঞ হজরত আমির খসরু হচ্ছেন কাওয়ালি গানের প্রবর্তক।

কাওয়ালী গায়কী:

সাধারণত দলগত ভাবে এই শৈলীর গান পরিবেশন করা হয়। দলের নায়ক (দলনেতা বা দলের প্রধান গায়ক) মূল গানের নেতৃত্ব দেন। সহ কণ্ঠশিল্পীবৃন্দ তাঁর সঙ্গে গলা মেলান বা “ধুয়া” তোলেন। কখনো দেখা যায় সহ-কণ্ঠশিল্পীও দু একটি তুক স্বাধীন ভাবে গেয়ে থাকেন। সচরাচর স্থায়ীতে ফেরার সময় সবাই মিলে একসাথে গেয়ে ওঠেন।

হজরত নিজাম উদ্দিন [দিল্লি] দরগায় কাওয়ালি : Qawwali_hazrat_nizamuddin_delhi_Wikimedia_Free_Image
হজরত নিজাম উদ্দিন [দিল্লি] দরগায় কাওয়ালি
কাওয়ালী খুবই তাল নির্ভর গান। এখানে গায়ক ও বাদকের লয়কারীর দক্ষতার উপরে কাওয়ালীর সফলতা অনেক অংশে নির্ভর করে। কাওয়ালিতে তাল রাখা হয় মূলত ঢোলক দিয়ে। এখন তবলার ব্যবহারও হয়। তবে তাল এবং সার্বিকভাবে কাওয়ালির চেহারা ফোটাতে একটা বড় ভূমিকা পালন করে সহ-শিল্পীবৃন্দ লয়কারীর সাথে হাততালি।

কাওয়ালি মূলত দাদরা ও কাহারবার কাওয়ালী ভার্সনের সাথে গাওয়া হয়। এছাড়া ধূমালি, রূপক, পশ্তু ইত্যাদি তালও ব্যবহৃত হয়। নুসরাত ফাতেহ আলী খান কাওয়ালীর লয়কারীর একটা বিশেষ মোকামে পৌঁছে দিয়েছেন, যেটাকে অতিক্রম করা খুবই কঠিন।

সচরাচর কাওয়ালি শুরু হয় কবিতা দিয়ে। সুরে সুরে কবিতা পড়তে পড়তে স্থায়ীতে ঢোকা হয়। সেই সাথে, যেই রাগের উপর ভিত্তি করে কাওয়ালিটি গাওয়া হবে, সেই রাগের আওচার চলে। প্রধান কাওয়াল কবিতাটি পড়েন। তবে অনেক সময় কবিতার লাইন শেষ হবার সময় বাকি শিল্পীদের কয়েকজন গলা মেলান। এভাবে স্থায়ী গাইবার মাধ্যমে মূল কাওয়ালীতে প্রবেশ করা হয়। কাওয়ালিতে স্থায়ীকে বার বার বিভিন্ন ভাবে গেয়ে খুব স্পষ্ট ভাবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়।

 

Qawwali_Wikimedia_Free_Image
জোড়া প্রধান কাওয়ালি গায়কও কোথাও কোথাও দেখা যায়।

কাওয়ালি গানে স্থায়ী ছাড়া একাধিক অন্তরা থাকতে পারে। অন্তরার মাঝে মাঝে রাগদারী বা লয়কারীর বিভিন্ন ধরনের কাজ করা হয়। কখনো ঠেকা বন্ধ রেখে রাগের বিভিন্ন প্রকার বিস্তার দেখানো হয়। এমনকি সুদক্ষ কাওয়াল ও সহ গায়ক হলে তারা স্কেল বদলে হারমনাইজ করেন।

তান কাওয়ালীর খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বলতে গেলে তান ছাড়া কাওয়ালী হয়ই না। “আ” কার বা সারগামে বিভিন্ন রকম তান করা হয়। সাপাট তান তো হামেশাই চলে, সাথে অন্যান্য তানেরও ব্যবহার হয়। অনেক সময় ২/৩ টি বোলে নিয়েও লম্বা করে গেয়ে একটা সাপাট তান দিয়ে সোমে ফেরা হয়। মূল গায়কের পাশপাশি অনেক সময় সহযোগী গায়কেরাও তাদের তানের প্রস্ততি দেখান। কাওয়ালিতে লয়কারীর সাথে বিভিন্ন ধরনের তানের ব্যবহার হয়। আর সব কিছুর সাথে হাত তালি তো রয়েছেই।

কাওয়ালী শিল্পীদল:

কাওয়ালী গাইয়েদের কাওয়াল বলা হয়। কাওয়ালী  গানের ধরনটিই এমন, যা একা গাওয়া সম্ভব নয়। তাই কাওয়ালরা একটি দলবদ্ধ হয়েই গান বাজনা করেন। প্রতিটি কাওয়ালীর দল মূলত একটি পরিবারের লোকজন বা খুব নিকটাত্মীয় স্বজন নিয়ে তৈরি হয়।

কাওয়াল রা শুধুমাত্র গাইয়ে নন, এদের খুব ইন্টারেস্টিং নিজস্ব রীতি-রেওয়াজ এবং জিবনাচার আছে। যেমন এরা একত্রে রেয়াজের সুবিধার্থে সচরাচর খুব কাছাকাছি বসবাস করে। এরা  প্রধান গায়ককে সকলে খুব মানে, তার বয়স যত কম-বেশি হোক। এমনকি প্রধান গায়ককে নিয়েই একটি কাওয়াল গ্রুপের জীবন আবর্তিত হয়।

cropped Music Gurukul Logo কাওয়ালি বা কাওয়ালী গান কি? [ Qawwali, Music Genre ] সুফি ফারুক ইবনে আবুবকর

কাওয়ালীর প্রধান গায়ক:

প্রধান গায়ক কে ওই ঘরানার বা পরিবারের খলিফাও বলা হয়। খলিফা বয়সের সাথে সাথে পরবর্তী খলিফা তৈরির জন্য তিনি অপেক্ষাকৃত তরুণ শাগরেদদের প্রশিক্ষিত করতে থাকেন। খলিফা তার জীবদ্দশায় পরবর্তী খলিফা নির্বাচন করে যান। খলিফার হঠাৎ মৃত্যু হলে দলের মুরুব্বীরা খলিফা নির্বাচন করেন। খলিফার বয়স যতই কম হোক, সবাই তাকে মেনে চলেন, সর্বজোষ্টের মতো সম্মান করেন।

Music Gurukul Logo 512x512 (84)

 

কাওয়ালীর ঘরানা:

উপমহাদেশে কাওয়াল বাচ্চা নামে একটা ঘরানা রয়েছে। অনেকেই এটিকে কাওয়ালীর ঘরানা বলে বিভ্রান্ত হন। এই ঘরানাটিও ধ্রপদ খেয়ালের ঘরানা। যেমন ছোট ছোট মুড়কি-তানের এই কাওয়াল বাচ্চা ঘরানাটির বিখ্যাত খেয়াল গায়ক সালামত-নাযাকত আলী খান, ভক্তি ও গজলের গায়ক অনুপ জালোটা। তাই  কাওয়ালীর গায়ক গা কাওয়াল অন্য যেকোন সঙ্গীতের ঘরানারও হতে পারে। ঘরানার কারণে তার রাগদারী বা লয়কারীর আন্দাজ আলাদা হতে পারে। কিন্তু কাওয়ালী গাইতে হলে কাওয়ালির প্রতিষ্ঠিত গায়কীতেই গাইতে হয়।

Music Gurukul logo of Gurukul Online Learning Network 350X70 V.02

 

কাওয়ালদের অন্যান্য রীতি রেওয়াজ:

অগ্রজ খলিফাতের মৃত্যু দিবস বা বারসি কাওয়ালরা খুব শ্রদ্ধার সাথে পালন করে। সেসব বারসির অনুষ্ঠানে আত্মীয়-স্বজন সবাই গান করেন। কোন কোন বারসিতে বাইরে থেকে অন্য কাওয়ালকে অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো হয়। খলিফার মৃত্যুর পরে তার প্রথম বরসিতে সবাই মিলে কাওয়ালির সাথে সাথে ক্রন্দন বিলাপ করে।

কাওয়ালী ও কাওয়ালদের গল্প আরব্য রজনীর মতো। কাওয়ালি সম্পর্কে এই মোটামুটি প্রাথমিক ধারণা দিতে তাই আজ এটুকুই।। বিস্তারিত জানতে সংশ্লিষ্ট বই পড়ুন বা আমাদের এই বিষয়ক কোর্স ফলো করুন।

 

লেখক:

সুফি ফারুক ইবনে আবুবকর

প্রমুখ, গুরুকুল

উপদেষ্টা, সঙ্গীত গুরুকুল