কমল দাশগুপ্ত । বাঙালি সঙ্গীতশিল্পী, সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক

কমল দাশগুপ্ত ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম প্রথিতযশা সঙ্গীতশিল্পী, প্রসিদ্ধ সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন। ত্রিশ এবং চল্লিশের দশকে গ্রামোফোন ডিস্কে তার সুরে গাওয়া বহু গান অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। গানগুলোর গীতিকার ছিলেন প্রণব রায় এবং কণ্ঠশিল্পী ছিলেন যুথিকা রায়। সাঁঝের তারকা আমি, আমি ভোরের যুথিকা প্রভৃতি গান আজও সমাদৃত। তার কয়েকটি রাগাশ্রিত, কীর্তনাঙ্গ এবং ছন্দ-প্রধান গানও সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।

কমল দাশগুপ্ত । বাঙালি সঙ্গীতশিল্পী, সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক

ব্যক্তিগত জীবন

শৈশবকালে বড় ভাই অধ্যাপক বিমল দাশগুপ্তের কাছে খেয়াল গান দিয়ে সঙ্গীত জীবন শুরু করেন। ডি. এল. রায়ের পুত্র দিলীপ রায়, কৃষ্ণচন্দ্র দে (কানা কেষ্ট) এবং ওস্তাদ জমিরউদ্দিন খাঁর কাছে খেয়াল, ঠুমরী, দাদরা ও গজলের তালিম গ্রহণ করেন তিনি। তার বাবার নাম তারাপ্রসন্ন দাশগুপ্ত। বড় ভাইয়ের নাম সুবল দাশগুপ্ত। ক্রীড়াজগতের স্বনামধন্য পঙ্কজ গুপ্ত সম্পর্কে তার মাতুল হন।

১৯৫৫ সালে বাংলাদেশের তথা ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম নজরুল সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব ফিরোজা বেগমকে বিয়ে করেন কমল দাশগুপ্ত। তখন তার বয়স ছিল ৪৩ বছর। বিয়ের চার বছর পর তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। ধর্মান্তরিত হওয়ার পর তার নাম রাখা হয় কাজী কামাল উদ্দীন। তাদের সংসারে তিন সন্তান – তাহসিন, হামিন ও শাফিন রয়েছে।

আর্থিক সমস্যা

১৯৪৬ সালেও কমল দাশগুপ্ত তখনকার সময়ে সাঁইত্রিশ হাজার টাকা আয়কর দিয়েছেন সরকারকে। সবসময় গাড়ি ব্যবহার করতেন। কিন্তু শেষ জীবনে এসে তিনি দেউলিয়া এবং নিঃস হয়ে পড়েন। ঢাকায় তিনি একটি মুদির দোকান দেন। ২০ জুলাই, ১৯৭৪ সালে প্রায় অযত্নে-অবহেলায় ও বিনা চিকিৎসায় ঢাকায় এই গুণী শিল্পী মৃত্যুবরণ করেন।

কমল দাশগুপ্ত । বাঙালি সঙ্গীতশিল্পী, সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক

সঙ্গীত জীবন

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের বহু জনপ্রিয় গানে তিনি সুরারোপ করেছেন। ১৯৩৪ সাল থেকে স্বাধীনভাবে কাজী নজরুল ইসলামের গানের সুরারোপ করতে থাকেন। প্রায় তিনশো নজরুলগীতির সুর রচয়িতা ছিলেন কমল দাশগুপ্ত।

২৩ বছর বয়সে হিজ মাস্টার্স ভয়েস গ্রামোফোন কোম্পানির সঙ্গীত-পরিচালক ও সুরকার হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন তিনি। কলাম্বিয়া রেকর্ড কোম্পানিতেও কর্ম সম্পাদন করেন। তিনি ছিলেন প্রথম বাঙালি যিনি উর্দু ভাষায় কাওয়ালি গান পরিবেশন করেন। এইচএমভিতে এক মাসে তিপ্পান্নটি গান রেকর্ড করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। হায়দ্রাবাদের নিজামের গোল্ডেন জুবিলির বিশেষ গান রেকর্ড করেন। ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি’র মার্চিং সং তার সুরে রেকর্ড করা হয়। রেকর্ডসংখ্যক গানে সুর করার জন্য ১৯৫৮ সালে এইচএমভিতে তার সিলভার জুবিলি অনুষ্ঠিত হয়।[১] তার সুরারোপিত গানের ডিস্কের সংখ্যা প্রায় আট হাজার।

রেডিও অডিশন বোর্ডের প্রধান ছিলেন তিনি। স্বরলিপির শর্টহ্যান্ড পদ্ধতির উদ্ভাবক হিসেবেও পরিচিতি পেয়েছেন। আ-কার মাত্রিক পদ্ধতি ও স্টাফ নোটেশন পদ্ধতি স্বরলিপি স্থাপনে সিদ্ধহস্তের অধিকারী ছিলেন কমল দাশগুপ্ত।

প্রায় ১০ বছর তিনি তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) অবস্থান করেন। ১৯৭২ সালে কলকাতায় বঙ্গ-সংস্কৃতি-সম্মেলন-মঞ্চে কমল দাশগুপ্তের ছাত্রী ও সহধর্মিণী হিসেবে ফিরোজা বেগম ছিলেন মুখ্যশিল্পী। তাদের উভয়ের দ্বৈতসঙ্গীত সকল শ্রোতা-দর্শককে ব্যাপকভাবে বিমোহিত করেছিল।

কমল দাশগুপ্ত । বাঙালি সঙ্গীতশিল্পী, সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক

চলচ্চিত্র জীবন

বাংলা চলচ্চিত্রের সুরকার হিসেবেও প্রভূত খ্যাতি অর্জন করেন কমল দাশগুপ্ত। তুফান মেল, শ্যামলের প্রেম, এই কি গো শেষ দান—চলচ্চিত্রসমূহের গানগুলো এককালে বিপুল সাড়া তুলেছিল। ভগবান শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য ছবিতে তার সুরসৃষ্টি স্মরণীয়। সঙ্গীত-পরিচালক হিসেবে তার শেষ ছবি ছিল বধূবরণ।প্রায় আশিটি ছায়াছবির সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন তিনি।

হিন্দি আধুনিক সঙ্গীত – ‘গীত’ প্রচারে তার অবদান অপরিসীম। ভজন গানে বিশেষ দক্ষ ছিলেন। বাংলা-হিন্দি-উর্দু-গজল, ভজন, উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত, নাত, হামদ, নজরুলগীতিসহ সঙ্গীতের সকল শাখায় সমান দক্ষতার অধিকারী ছিলেন কমল দাশগুপ্ত।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়ে মি. এলিস জনসন নামীয় একজন আমেরিকান চিত্র-পরিচালক কর্তৃক তার ওয়ার প্রপাগান্ডা ছবির জন্য কমল দাশগুপ্তের কাছ থেকে আবহ সঙ্গীত গ্রহণ সবিশেষ গুরুত্ব বহন করে।

রেডিও বাংলাদেশের ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিসের প্রধান সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন তিনি।

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment