হিন্দুস্থানী সঙ্গীতে রাগ: প্রাচীন সঙ্গীত শাস্ত্রে স্বর ও বর্ণ দ্বারা ভূষিত ধ্বনিবিশেষকে রাগ বলা হয়। এটি মানবচিত্তে এক ধরনের রঞ্জক ধ্বনির আবহ সৃষ্টি করে। ধাতুগত অর্থ করতে হলে, যে স্বর লহরী মনকে রঞ্জিত করে তাকে রাগ বলা হয়। রাগসঙ্গীত, সংগীতের মূলধারার অংশ।
দেখুন : হিন্দুস্তানী শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে রাগসমূহের তালিকা
ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের একটি রূপ কাঠামো, যা সঙ্গীতোপযোগী ধ্বনি সুনির্দিষ্ট ধ্বনি বিন্যাসে সৃষ্ট হয় এবং শ্রোতার মনকে রঞ্জিত করে। এটি ভারতীয় সঙ্গীত পদ্ধতিতে রাগ হলো মনোরঞ্জনকারী সমন্বিত একটি বিশিষ্ট সুরশৈলী।
রাগ শব্দের আক্ষরিক অর্থ হলো- যার উপস্থিতিতে মন রঞ্জিত হয়। রাগের মনোরঞ্জনের প্রাথমিক রূপ সৃষ্টি হয় মনে। এর মৌলিক উপাদান অনাহত নাদ। ভৌত জগতে আহত নাদের দ্বারা প্রকাশিত হয়। এই অনাহত সঙ্গীত অনাহত ছন্দ নিবদ্ধ হলে, রাগের প্রাথমিক অরূপ মূর্তি তৈরি হয়। এর সাথে রসের আবির্ভাব হলে, রাগ পূর্ণতা পায়।
নানা ধরনের স্বরবিন্যাসে রাগের নানা ধরণ তৈরি হয়। তার সবই অরূপমূর্তি রূপে অনাহতের নাদের আশ্রয়ে মনের গভীরে ধ্বনিত হয়। সুনির্দিষ্ট কোনো রাগ হলো- বহুবিধ সঙ্গীতোপযোগী শব্দ বা ধ্বনি-শৈলির অরূপমূর্তির একটি মিশ্ররূপ।
ভারতীয় সঙ্গীতশাস্ত্রের আদি ধ্বনিরূপকে নাদ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এর দুটি রূপ হলো- অনাহত নাদ (অশ্রুত শব্দব্রহ্ম) ও আহত নাদ। আহত নাদ সৃষ্টির হয় আঘাতজনিত কারণে বস্তুর কম্পনের সূত্রে। সঙ্গীতোপযোগী ধ্বনিকম্পাঙ্কের দ্বিগুণাত্মক সূত্রে সৃষ্টি হয় স্কেল। এই স্কেলের সমগুণান্বিত দ্বাদশ ভাগের প্রতিটি ভাগ হলো স্বর। আর একাধিক স্বর মিলিত হয়ে তৈরি হয় সুর। সুর নানা ভাবে তৈরি হতে পারে। সঙ্গীতের রূপের বিচারে একে বলা যায় সুরের মৌলিক রূপ। দুটি স্বর মিলে যত ধরনের সুর তৈরি হবে, তার সবগুলোই হবে মৌলিক রূপ। দুইয়ের বেশি স্বর মিলে তৈরি হবে যৌগিক ক্ষুদ্ররূপ। এই রূপগুলো হতে পারে বিচ্ছিন্ন ধারায়, অবিচ্ছন্ন ধারায়। অবিচ্ছিন্ন ধারার সুর হতে পারে সরল, বক্র বা মীড়যুক্ত। আর অবিচ্ছিন্ন ধারার সুরে রয়েছে সরল ও বক্র।
ক্ষুদ্রসুর যখন কোনো নান্দনিক হয়ে উঠে এবং একটি ক্ষুদ্র সুরকাঠামো তৈরির উপযোগী হয়ে উঠে, তখন তাকে বলা হয় সাঙ্গীতিক স্বরগুচ্ছ (phrase, musical phrase)। এরূপ নানা জাতীয় সুর ও স্বর মিলিত হয়ে তৈরি হয়, নানা ধরনের সুরশৈলী। এক বা একাধিক সুরশৈলীর সমন্বয়ে সৃষ্ট স্বরবিন্যাস যখন একটি বিশেষ শৈলীকে উপস্থাপন করে, তখন সুরাঙ্গের ( musical style) সৃষ্টি হয়। ভারতীয় সঙ্গীতে সাধারণভাবে একে বলা হয় ‘অঙ্গ’। যেমন-ভৈরব অঙ্গ, কাফি অঙ্গ, কানাড়া অঙ্গ।
এই সকল অঙ্গের সাথে আরও কিছু সুরশৈলী বা ক্ষুদ্রসুর যুক্ত হয়ে যে সুরকাঠামো গড়ে উঠে, তাতে রাগাঙ্গের রূপ ফুটে উঠে। একে রাগ হিসেবে বিশেষভাবে চিহ্নিত করা ক্ষেত্রে কতকগুলো বিধিকে অনুসরণ করা হয়। এই বিধির দ্বারা রাগের লক্ষণ সৃষ্টি হয়।
রাগের গাঠনিক ভিত্তি হিসেবে প্রাথমিকভাবে একটি স্বরসপ্তক থেকে নির্বাচিত কিছু স্বরকে গ্রহণ করা হয়। একে বলা যায় রাগের ব্যবহারিক স্বরতালিকা। যেমন ইমন রাগে ব্যবহৃত স্বরসপ্তক হলো- স র গ হ্ম প ধ ন। স্কেলের বা স্বরাষ্টকের বিচারে এর রূপ স র গ হ্ম প ধ ন র্স। এখানে কোনো স্বরকে দুইবার গ্রহণ করা হয় নি। ইট, কাঠ, লোহা ইত্যাদি যেমন বাড়ি নয়, তেমনি ‘স র গ হ্ম প ধ ন র’ ইমন রাগ নয়। যে কোন রাগের নির্ধারিত রূপ ফুটে, ওই রাগের জন্য নির্বাচিত স্বরের বিন্যাসের ভিতর দিয়ে।
এক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখে কিছু নির্বাচিত সুরশৈলী এবং অন্যান্য কিছু স্বরের বিধিবদ্ধ সমন্বিত প্রয়োগ। একটি রাগকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করা জন্য বিশেষ কিছু শর্ত বা বিধি মান্য করা হয়। প্রাথমিকভাবে রাগ-পরিচিতিতে দুটি বিষয়কে মান্য করা হয়। এর একটি হলো আরোহণ-অবরোহণ, দ্বিতীয়টি জাতি।
Table of Contents
হিন্দুস্থানী সঙ্গীতে রাগ । ধারণা । হিন্দুস্থানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীত
রাগের সংজ্ঞা:
“রঞ্জয়দি ইতি রাগ”—যে স্বর রচনা মানুষের চিত্তরঞ্জন করে তাকে বলা হয় রাগ। ‘সংগীত দর্পণ’-কার রাগের নির্ণয় করতে গিয়ে বলেছেন:
যোহয়ং ধ্বনিবিশেষস্তু স্বরবর্ণবিভুষিতঃ।
রঞ্জকো জনচিত্তানাং স রাগঃ কথিতো বধৈঃ॥ ৬২
অর্থাৎ ধ্বনির সেই বিশিষ্ট রচনা স্বরবর্ণবিভূষিত হয়ে জনচিত্ত রঞ্জন করে বুদ্ধিমান ব্যক্তি তাকেই বলেন রাগ।
অথবা
যস্য শ্রাবণামাত্রেণ রজ্যন্তে সকলাঃ প্রজাঃ।
সর্ব্বানুরঞ্জনাদ্ধেতোন্তেন রাগ ইতি স্মতঃ॥
উপরিউক্ত সংজ্ঞাগুলি ব্যাপকার্থে প্রয়োগ করা হয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে রাগ রচনায় কতকগুলি আবশ্যিক নিয়মকানুন আছে যার ব্যতিক্রম ঘটলে সেই রচনাকে ‘রাগ’ আখ্যা দেওয়া চলবে না, যেমন—
- রাগকে কোন ঠাট থেকে উৎপন্ন হতে হবে।
- রাগ রচনায় অন্যুন পাঁচটি স্বর ব্যবহার করতে হবে।
- রাগের রঞ্জকত গুণ থাকবে।
- কোনো রাগেই ষড়জ স্বরটি বর্জিত হবে না।
- রাগের আরোহ এবং অবরোহ, পকড়, সময় ইত্যাদির নির্দেশ থাকবে।
- রাগে বাদী এবং সম্বাদী স্বর অবশ্যই থাকবে এবং একটি থেকে অপরটির দূরত্ব কমপক্ষে ৭ শ্রুতি হতে হবে।
- কোনো রাগেই মধ্যম এবং পঞ্চম স্বর একত্রে বর্জিত হবে না।
- কোন রাগেই একই স্বরের দুইটি রূপ (যেমন ঋা, রা; মা, হ্মা) একই সঙ্গে প্রয়োগ হবে না।
- রাগে স্বর তথা বর্ণের ব্যবহার অপরিহার্য।
- রাগে একটি বিশেষ রসের অভিব্যক্তি থাকবে।
- রাগের জাতি বিভাগ থাকবে; যেমন ঔড়ব, ষাড়ব, সম্পূর্ণ।
রাগের আরোহণ-অবরোহণ:
প্রতিটি রাগের রয়েছে সুনির্দিষ্ট আরোহণ/অবরোহণের স্বরসমষ্টি। যেমন-
রাগ ভূপালী: স র গ প ধ র্স/র্স ধ প গ র স
রাগ মালকোষ: স জ্ঞ ম দ ণ র্স/র্স ণ দ ম জ্ঞ স
রাগ ভৈরবী: স ঋ জ্ঞ ম প দ ণ র্স/র্স ণ দ প ম জ্ঞ ঋ স।
রাগের জাতি:
কোনো রাগের আরোহী অবরোহী তে ব্যবহৃত স্বরের সংখ্যা অনুযায়ী রাগের যে শ্রেণীবিন্যাস করা হয় তাকেই রাগের জাতি বলা হয়। অর্থাৎ সব রাগেই যে সাতটি করে স্বর ব্যবহৃত হবে এমন নয়।কখনো কখনো কোন কোন রাগে ছয়টি আবার কোন কোন রাগে পাঁচটি স্বরও ব্যবহৃত হয়।জাতি প্রধানত তিন প্রকার।যথা: সম্পূর্ণ জাতি:সাতটি স্বরই ব্যবহৃত হয় এই রাগে। ষাড়ব জাতি :এই রাগে ছয়টি স্বর ব্যবহৃত হয়। ঔড়ব জাতি :এই রাগে পাঁচটি স্বর ব্যবহৃত হয়।
রাগের আরোহণ/অবরোহণে ব্যবহৃত স্বরের সংখ্যানুসারে রাগের জাতি নির্ধারিত হয়। সাধারণভাবে রাগে ৫, ৬ বা ৭টি স্বর ব্যবহৃত হয়। পাঁচ স্বরে রাগকে বলা হয় ঔড়ব, ছয় স্বরের রাগকে বলা হয় ষাড়ব আর সাত স্বরের রাগকে বলা হয় সম্পূর্ণ। রাগের জাতি নির্ণয়ের ক্ষেত্রে এটি সাধারণ হিসাব। কিন্তু একটু বিশেষভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, অনেক রাগের আরোহণ এবং অবরোহণের স্বরসংখ্যা একই রকমের হয় না। যেমন খাম্বাজ রাগের আরোহণে ব্যবহৃত হয় ৬টি স্বর (স গ ম প ধ ন র্স), অবরোহণে ব্যবহৃত হয় ৭টি স্বর (র্স ণ ধ প ম গ র স)। এই বিচারে জাতি হবে ষাড়ব সম্পূর্ণ। এই বিচারে রাগের জাতি হবে-
সম্পূর্ণ-সম্পূর্ণ, সম্পূর্ণ-ষাড়ব, সম্পূর্ণ-ঔড়ব
ষাড়ব-সম্পূর্ণ, ষাড়ব-ষাড়ব, ষাড়ব-ঔড়ব
ঔড়ব-সম্পূর্ণ, ঔড়ব-ষাড়ব, ঔড়ব-ঔড়ব
এছাড়া চার স্বরের কিছু রাগ আছে যাদের স্বর সংখ্যা চারটি। এই জাতীয় রাগকে বলা হয় স্বরান্তর।
উপরের দুটি শর্তকে প্রাথমিক বিধি বলা হয়, রাগের স্বর-উপাদানের বিচারে। এই বিচার করা হয় একটি স্বরসপ্তকের বিচারে। রাগরূপ সৃষ্টি হয় এই দুটি বিধিকে ভিত্তি করে বিশেষ স্বরবিন্যাসের মাধ্যমে। রাগের রূপ নির্ণয়ে এই স্বরবিন্যাসকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়।
রাগে সুর:
সঙ্গীততত্ত্বের বিচারে ‘সুর’ শব্দটি একটি বিশেষ অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। এটি নিতান্তই সঙ্গীতের পারিভাষিক শব্দ। তাই ভিন্ন অর্থে সুর যাই হোক এখানে তা গ্রহণ করা হবে না। এক্ষেত্রে সুর হলো- দুই বা ততোধিক স্বরের বিন্যাস, যা স্বরগুলোর শ্রবণ-রেশের ভিতর ধ্বনিত হবে এবং ধ্বনি মাধুর্য তৈরি করবে। একটি স্বরকে দীর্ঘক্ষণ ধরে টানা বাজতে থাকলে তা হবে স্বর। কিন্তু একটি স্বরের শ্রবণ-রেশের ভিতরে ধ্বনিত হলে তা সুরে পরিণত হবে। এই বিচারে সুরকে প্রাথমিকভাবে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন-
১. বিচ্ছিন্ন সুর: যখন প্রতিটি স্বরের ভিতরে শ্রবণ বিরাম পাওয়া যায়। কিন্তু এই বিরাম সামান্য সময়ের জন্য ঘটে, ফলে শ্রোতা স্বরগুলোকে বিচ্ছিন্নভাবে শুনলেও শ্রবণ অনুভবের ভিতরে অবচ্ছিন্নভাবেই পায়। এই সুর হতে পারে তিন প্রকার। প্রকার তিনটি হলো- আরোহ, অবরোহ ও বক্র। ২. অবচ্ছিন্ন সুর: কোনো ধ্বনি মানুষের শ্রবণেন্দ্রিয়কে যখন উজ্জীবিত করে, তখন তার রেশ ১/১০ সেকেন্ড পর্যন্ত থেকে যায়। এই সময়ের মধ্যে দুটি ধ্বনি মানুষের কাছে অবচ্ছিন্ন মনে হয়। এই জাতীয় সুর হতে পারে- চার প্রকার। প্রকার চারটি হলো আরোহ, অবরোহ, বক্র ও মীড়।
সুরের প্রকৃতি বিচারে যে কোনো রাগ হলো- সুরের প্রবহমানতা। যেহেতু প্রতিটি রাগের নিজস্ব স্বর-সেট রয়েছে। তাই এক্ষেত্রে প্রতিটি রাগের নিজস্ব সুরের রূপ তৈরির একটি ধাপ সম্পন্ন হবে। এর দ্বারা চূড়ান্ত রূপ পাওয়া যাবে না অন্তত একটি কারণে, তা হলো একই স্বর ও স্বরসংখ্যা একাধিক রাগে থাকতে পারে। একাধিক রাগের যখন একই স্বর ও স্বরসংখ্যা থাকে, তখন ওই রাগগুলো সমপ্রকৃতির রাগের ইঙ্গিতও দেয়। কিন্তু পরিপূর্ণভাবে সমপ্রকৃতির রাগ হয়ে উঠে না। এক্ষেত্রে বিশেষ নিয়ামক হয়ে হয়ে উঠে এর স্বরগুচ্ছ ও সুরশৈলী।
স্বরগুচ্ছ ও সুরশৈলী:
কিছু স্বর একত্রিত হয়ে বিশেষ ধরনের সুর তৈরি করে। এই বিশেষ সুরগুলো ব্লক হিসেবে নিজস্ব ধ্বনিরূপ পায়। এই অবস্থায় এগুলোকে স্বরগুচ্ছ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যেমন- সরগ, রগম, গমপ। অনেক সময়ই এদেরকে কোনো টানা সুরের ভিতরে আলাদা করে চেনা যায়। যেমন-
স স স। স র গ। র গ ম। গ মপ। প ম গ। র স স।
এখানে, প্রথম ‘সসস’ একটি পৃথক স্বরগুচ্ছ। এর পরে রয়েছে স র গ। র গ ম। গ ম প- তিনটি স্বরগুচ্ছ। কিন্তু বক্ররীতিতে একটি সুররূপ তৈরি করেছে। এই সুররূপগুলো যেন পরস্পরের অনুষঙ্গী হয়ে চলছে। কবিতার অনুপ্রাসের মতই এই তিনটি স্বরগুচ্ছ যেন এক ধরনের সুর-প্রতিধ্বনির সৃষ্টি করে এগিয়ে চলে। আরে শেষের প ম গ। র স স হলো অবরোহী স্বরগুচ্ছ।
প্রতিটি রাগের রয়েছে কিছু নিজস্ব স্বরগুচ্ছ। এগুলো ছোটো ছোটো সুরের নকশা তৈরি করে, একটি সুরশৈলীকে প্রকাশ করে। মূলত এই স্বরগুচ্ছ রাগের মৌলিক রূপকে ধারণ করে। তাই রাগের ক্ষেত্রে এই স্বরগুচ্ছকে সাঙ্গীতিক স্বরগুচ্ছ ( phrase, musical phrase )। অবশ্যই সাধারণ স্বরগুচ্ছ থেকে সাঙ্গীতিক স্বরগুচ্ছ স্বতন্ত্র। সাধারণ সাঙ্গীতিক স্বরগুচ্ছ সাধারণভাবে সুরের প্রয়োজনে যেকোনো ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যায়। কিন্তু বিশেষ রাগের ক্ষেত্রের জন্য বিশেষ সাঙ্গীতিক স্বরগুচ্ছ ব্যবহার করতেই হয়, তা না হলে রাগ-রূপ নষ্ট হয়ে যায়।
শুধু সাঙ্গীতিক স্বরগুচ্ছ দিয়ে রাগরূপ ফুটে উঠে না। এর জন্য রাগে ব্যবহৃত অন্যান্য স্বরগুলোরও প্রয়োজন হয়। মূলত রাগের মূল সাঙ্গীতিক স্বরগুচ্ছের সাথে অন্যান্য স্বরের সুসমন্বয়ে রাগরূপ ফুটে উঠে। এক্ষেত্রে অন্যান্য স্বরগুলোর প্রয়োগের ক্ষেত্রে বিবেচনা করতে হয়, প্রতিটি স্বরের স্থিতিকাল। একটি স্বর থেকে পরের স্বরের যাওয়ার সময়টা কতটুকু হবে, সেখানে মীড়ের ব্যবহার হবে কিনা, কোনো বিশেষ প্রয়োগের সময় অন্য স্বরের স্পর্শ লাগবে কিনা, অবরোহণের রীতিতে স্বরের চলন হবে না কি উলম্ফন হবে- এই জাতীয় বিষয়গুলো বিশেষ বিবেচনায় রাখতেই হবে।
এছাড়া আছে রাগের শুরুতে কোন স্বর ব্যবহার করতে হয় (গ্রহস্বর) এবং রাগের চলনের সময় কোনো কোন স্বরে থামতে হয় (ন্যাসস্বর) ইত্যাদিও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এছাড়াও রয়েছে রাগের জন্য বাদীস্বর, সম্বাদী স্বর, বিবাদীস্বর, বর্জিত স্বর ইত্যাদি। আরও রয়েছে রাগরূপায়ণে নানা ধরনের অলঙ্কার। পরিবেশনের অঙ্গ হিসেবে অলঙ্কারে প্রকৃতিতেও রয়েছে বিভিন্নতা। যেমন- খেয়াল, ধ্রুপদ, টপ্পা, গজল, ঠুমরি, ভজন ইত্যাদির রয়েছে কিছু সাধারণ সুরালঙ্কার, আবার কিছু রয়েছে বিশেষিত অলঙ্কার। সব মিলিয়ে প্রতিটি রাগ যে বিশেষ ধ্বনি সৌন্দর্য তৈরি করে, তাই হলো ওই রাগের রূপ। রাগরূপে উল্লেখিত বৈশিষ্ট্যের বিচারে প্রতিটি রাগের তৈরি হয় নিজস্ব ধ্বনিসৌর্ভ ও ধ্বনি-আভিজাত্য। যা দিয়ে সৃষ্টি হয় প্রতিটি রাগের স্বতন্ত্র রূপ, বলা যায় রাগ-ব্যক্তিত্ব। এর উদাহরণ হিসেবে ইমন রাগের রূপ যৎকিঞ্চিৎ আলোচনা করবো।
রাগের প্রধান পরিচয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত। কারণ রাগ মাত্রেই কিছু অত্যাবশ্যকীয় বিধির দ্বারা নির্ধারিত হয়ে থাকে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রথাগত বিধি মেনেই সামান্য পরিবর্তন করা হয়। তবে এই পরিবর্তনেরও বিধি আছে।
রাগ নাম:
শাস্ত্রমতে একটি রাগের সুনির্দিষ্ট নাম থাকতে হবে। বাস্তবে রাগ-নামের নানা হেরফের লক্ষ্য করা যায়। যেমন-
সংক্ষেপিত নাম: মূল নাম দরবারী কানাড়া। সংক্ষেপে দরবারী কানাড়া
আঞ্চলিক নাম: কোনো কোনো রাগ আঞ্চলিক ভাষার কারণে রাগের নামের পরিবর্তন ঘটেছে। যেমন: সংস্কৃতি ভাষার ভৈরব রাগটি, হিন্দি মারাঠী ভাষায় হয়েছে ভৈরো। সংস্কৃত ভীমপলশ্রী, বঙ্গদেশে হয়েছে ভীমপলাসী। আবার অনেক রাগের নাম উত্তর ভারতীয় পদ্ধতি ও দক্ষিণ ভারতীয় পদ্ধতির সূত্রে ভিন্নতর হয়েছে। যেমন- উত্তরভারতীয় রাগ বিলাবল। দক্ষিণ ভারতীয় নাম শংকরাভরণ্ বা ধীরশঙ্করাভরণ্।
বিবর্তিত সমনাম: প্রাচীন কিছু রাগের নাম ক্রমবিবর্তনের ধারায় ভিন্নতর নাম পরিগ্রহ করেছে। যেমন- ডোম্বিক্রি নামটি হয়ে গেছে ভূপালী।
রাগকে অভিহিত করা হবে। কোনো কোনো রাগের একাধিক নাম থাকতে পারে। যেমন- দরবারী এবং দরবারী কানাড়া একই রাগ। রাগের ক্রমবিবর্তনের ধারায় কোনো কোনো রাগের নামের পরিবর্তন হয়েছে। যেমন- ডোম্বিক্রি রাগটি বর্তমানে ভূপালী নামে পরিচিত। নামের বানানের কারণে, উচ্চারণ শৈথিল্যে রাগের নাম নান।
রাগের ঠাট:
ঠাট হলো রাগের শ্রেণিকরণের নাম বিশেষ। দক্ষিণ ভারতীয় পদ্ধতিতে এর সমতূল্য নাম মেল। দক্ষিণ ভারতে মেলের সংখ্যা ৭২টি। বেঙ্কটমখী এবং গোবিন্দাচার্যের মেল বিভাজনে নামের পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। উত্তর ভারতে ভাতখণ্ডেজির প্রণীত ১০ ঠাট মান্য করা হয়।
ভাতখণ্ডেজির প্রণীত ১০ ঠাট
রাগের বাদী ও সমবাদী:
রাগের সবেচেয়ে প্রাধান্য পায় এমন স্বর বাদী এবং বাদী স্বর থেকে কম কিন্তু অন্যান্য স্বর থেকে বেশি ব্যবহৃত হয়, এমন স্বর সমবাদী। বাদী স্বরের বিচারে সমবাদী স্বর নির্ধারণে দুটি শর্ত অনুসরণ করা হয়।
১. বাদী স্বর থেকে নবম বা ত্রয়োদশ শ্রুতিতে অধিষ্ঠিত স্বরকে সমবাদী বলা হয়।
২. সমশ্রুতি-বিশিষ্ট স্বরদ্বয় পরস্পরের বাদী ও সম্বাদী হবে।
প্রথম শ্রুতি অনুসারে দেখা যায় বাদী স্বরের বিচারে নবম বা ত্রয়োদশ শ্রুতিতে সমবাদী হয়। তা হলে ষড়্জ বাদী হলে মধ্যম বা পঞ্চম সম্বাদী হতে পারে। লক্ষ্য করা যায় মধ্যসপ্তকের ষড়্জ থেকে মন্দ্রসপ্তকের মধ্যম ত্রয়োদশ শ্রুতিতে পাওয়া যায়। এবং মন্দ্রমধ্যমের দ্বিগুণ স্বর হয় বলে মধ্যসপ্তকের মধ্যম, ষড়্জ থেকে নবম শ্রুতিতে সম্বাদীর মর্যাদা পায়। অনেকে বাদী-সমবাদীকে ‘ষড়্জ-পঞ্চম ভাব’ হিসাবে আখ্যায়িত করে থাকেন।
রাগের অঙ্গ:
স্বরাষ্টকের আটটি স্বরকে (স র গ ম প ধ ন র্স) দুটি ভাগে করলে, তার প্রত্যেকটি ভাগকে অঙ্গ বলা হয়। যেমন : স র গ ম ও প ধ ন র্স। এর পূর্বভাগকে (স র গ ম) বলা হয় পূর্বাঙ্গ, এবং উত্তরভাগকে (প ধ ন র্স) বলা হয় উত্তরাঙ্গ। কোনো কানো মতে এই বিভাজন হয় তিন প্রকার। এই মতে পূর্বাঙ্গ (স র গ), মধ্যাঙ্গ (ম প) ও উত্তরাঙ্গ (ধ ন র্স)। স্বরাষ্টকের দুই ভাগে যারা বিশ্বাসী- তাদের কেউ কেউ প-কে পূর্বাঙ্গ ধরে থাকেন।
রাগের চলন যে অঙ্গকে অবলম্বন করে রচিত তার বিচারে- রাগকে সেই অঙ্গের বিচার করা হয়। তা ছাড়া রাগের বাদী স্বরকে কেন্দ্র করে রাগরূপায়ণ ঘটে থাকে। তাই বাদী স্বরের বিচারে রাগকে পূর্বাঙ্গ বা উত্তরাঙ্গ প্রধান হিসেবেও বিবেচনা করা হয়।
কোনো কোনো রাগের স্বরবিন্যাস কখনো কখনো এমন কোনো বিশিষ্ট্ রূপ ধারণ করে, যা অন্যত্র ওই বিশেষ রূপেই নিজেকে প্রকাশ করে থাকে। এই বিশেষ রূপকে অঙ্গ বলা হয়। রাগের ক্ষেত্রে এরূপ অঙ্গ কোনো বিশেষ নামে চিহ্নিত হয়ে থাকে। যেমন- কানাড়া অঙ্গ।
রাগের পকড়:
হিন্দি পকড় শব্দের অর্থ ‘ধরা’। বাংলাতে হিন্দির মতো তীর্যক অ-এর উচ্চারণ হয় না। তাই বাংলাতে এর উচ্চারণ হবে ‘পকোড়্’। সঙ্গীত শাস্ত্রের অত্যল্প স্বরের দ্বারা রাগের রূপ প্রকাশ করার প্রক্রিয়াই হলো– পকড়। যেমন ইমন রাগের পকড় হতে পারে, পহ্মগরগহ্মপ। কোনো বিশেষ রাগের পকড়ের স্বরগুলো এমনভাবে নির্ধারণ করা হয়, যাতে অন্য কোনো রাগের থেকে ওই বিশেষ রাগকে পৃথকভাবে নির্দেশিত করা যায়।
রাগের সময়:
ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে রাগ পরিবেশনের সময়কে অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে মান্য করা হয়।
আরও পড়ুন:
6 thoughts on “হিন্দুস্থানী সঙ্গীতে রাগ । ধারণা । হিন্দুস্থানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীত”