সখীসংবাদ বা সখী সংবাদ [ Shokhi Shongbad of Kavigan, Kobi Gaan, Kobi Lorai or Kabigan ] : কবিগানের অন্যতম প্রধান অংশ সখীসংবাদ এর গঠন কাঠামো মালশি গানের অনুরূপ। কবিগানের এই অংশ থেকে কবিগানের সঙ্গীত প্রতিযোগিতা শুরু হয়। এক দল আসরে এসে এই ধরনের একটি গান পরিবেশন করলে অন্য দলকে আসরে এসে তার জবাব রচনা করে গাইতে হয়।
পুরোপুরিভাবে রাধাকৃষ্ণভিত্তিক এই গানে প্রায় ক্ষেত্রে রাধা বা কৃষ্ণ তার সখীদের নিকটে অথবা সখীদের মাধ্যমে রাধা বা কৃষ্ণ পরস্পরের নিকট ভাবের দান-প্রদান করে থাকে বলে গানগুলোর নাম হয়তো এমন হয়েছে।
বৈষ্ণবীয় আবহের এই গানে রাধাকৃষ্ণের প্রেমকাহিনির বিভিন্ন পর্যায়ের অনুসরণে সখীসংবাদ গানের বিভিন্ন রকম নাম হয়, যেমন— পূর্বরাগ, অনুরাগ, অভিসার, মান, আক্ষেপ, কলহান্তরণ, প্রেমবৈচিত্র্য, বিরহ, মাথুর, মিলন প্রভৃতি। সুবল সংবাদ, উদ্ধব সংবাদ, প্রভাস যজ্ঞ, বসন্ত প্রভৃতি নামের গানকেও সখীসংবাদ গানের অন্তর্ভুক্ত ধরা যায়, যদিও এসব গানে সখীর পরিবর্তে সখার উপস্থিতি স্পষ্টত লক্ষণীয়। অর্থাৎ লিঙ্গভেদ নয়, কবিগানের রাধাকৃষ্ণবিষয়ক গানগুলোই সখীসংবাদ নামে পরিচিত।
এগুলোর মধ্যে ‘বসন্ত’ গানের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে। সরস্বতী পূজার আগে এই গান গাওয়ার রীতি নেই। সাধারণত বসন্ত রাগিণীতে বসন্ত গান গাইতে হয়। খুব প্রতিভাবান কবিয়াল ছাড়া এই ধরনের গান রচনা করা বা জবাব রচনা করা এবং এই গান পরিবেশন করা খুব কঠিন কাজ।
রাধাকৃষ্ণের কাহিনির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সম্পর্ক না থেকেও অনেক গান সখীসংবাদ হিসেবে পরিচিতি পায়। রাজেন্দ্রনাথ সরকারসহ একাধিক কবিয়ালের ‘জানকীর ফুলসজ্জা’ নামের সখীসংবাদ এর উজ্জ্বল উদাহরণ। শেষোক্ত সখীসংবাদটি মতুয়া সম্প্রদায়ের মিথ অনুযায়ী রচিত। নিম্নে নিশিকান্ত সরকারের একটি সখীসংবাদ এবং তার জবাব উদ্ধৃত করা হলো:
নিশিকান্ত সরকারের ‘মানযোগী’ শীর্ষক সখীসংবাদ:
চিতান করে চন্দ্রার বাড়ি লীলাসাঙ্গ যোগী সেজে শ্যাম ত্রিভঙ্গ প্রভাতে মানকুঞ্জে উদয়।
পাড়ন দেখে নূতন যোগী বিষয়ত্যাগী লম্পট গোবিন্দে দুঃখে দূতী বৃন্দে ব্যঙ্গ করি কয় ॥
১ম ফুকার তোমার ভিতর কালা বাইরে রাঙা ঠিক যেন দেখিতে মাকাল। যেমন ধুলা মেখে সাজে সাধু মাঠের গো-রাখাল। দেশগায়ে সাধু কোলায়, না বাঁচলে পেটের জ্বালায় যেমন দায়ে ঠেকিলে চিড়ের ছালায় পাছে হয় বৈরাগী নাকাল ॥
মিশ সাধুর কোন দেশে ধাম, ধরো কী নাম, কী মনে ক’রে এলে কুঞ্জের দ্বারে নিশি ভোরে কও দেখি রথে কিংবা পায়ে হেঁটে।
মুখ মুখ আজি পূর্ণিমার নিশি কোন আশ্রমে উপবাসী রজনী কাটে ॥
প্যাঁট ভবে যোগীগণের শুদ্ধমতি, যোগবলে মুখে ফোটে ব্রহ্মজ্যোতি তোমার সে চিহ্ন নাই মোটে। কতো ক্ষতচিহ্ন হচ্ছে লক্ষ পক্ বিম্ব ঠোঁটে। ভালে নাই চন্দনের ফোটা, সিন্দূরের তিলক কাটা একি কচি সাধুর রূপের ছটা, কলঙ্কী চাঁদ লোটায় মাথা কুটে। দেখে তোমার মলিন মুখ, বুক ফাটে ॥
২য় ফুকার পরে যোগীগণে গৈরিক বস্ত্র তোমার তো দেখি না তেমন তুমি কোন আশ্রমের নীলকাপুড়ে সাধু মহাজন। করেতে নাই কোদণ্ড, আছে এক বাঁশের খণ্ড পেয়ে দুর্দিনে কোন দুর্দণ্ড করেছে সর্বস্ব হরণ ॥
মিশ তোমার দশা দেখে কষাঘাতে অন্তরে জাগে বুঝি পড়েছো কি কৰ্মভোগে, করিলে মাথামুণ্ডন দোষ কাটে। আজি পূর্ণিমার নিশি কোন আশ্রমে উপবাসী রজনী কাটে ॥
অন্তরা থাকিতে ভোগবিলাস ভক্তদাস, কি আশে সন্ন্যাসে দিয়েছো মন। কিসের অপরাধে বেড়াও কেঁদে গো হয়েছে সুধাহীন বিধুবদন। দিয়ে চোরের নৌকায় সাধুর নিশান ঘোরো দেশবিদেশ যেমন আঠা-মাখা জটাধারী ঈশান ব্যোমকেশ। তোমায় মানায়েছে বেশ। তোমার এই বৈরাগ্যের বিধিনির্দেশ গো আছে কি পুনর্বার গৃহে গমন ॥
পরিচিতান যেন বিষের কুম্ভ দুগ্ধে ঘেরা তেমনি তোমার এই চেহারা। ঠিক যেন বিষামৃতময়।
পরপাড়ন কেন ভোজের বাজি দেখাও আজ ব্রজগোপীকে এসব দৃশ্য দেখে ঘোচে না সংশয় I
শেষ ফুকার তাকাও আড় নয়নে সবার পানে, মনে হয় তোমাকে দেখিলে। যেমন উপবাসী বকতপস্বী সরসী সলিলে। ঠারো চোখের আড়াল থেকে সাজিয়ে ময়ূর পাখে যদি কাক পড়ে স্বজাতির ঝাকে, ঠোকর আর নখের আঁচড় মিলে।।
ছুট্টি সাধুর কোন দেশে ধাম, ধরো কী নাম, কী মনে ক’রে এলে কুঞ্জের দ্বারে নিশি ভোরে কও দেখি রথে কিংবা পায়ে হেঁটে ॥
নিশিকান্ত সরকারের এই ‘মানযোগী’ শীর্ষক সখীসংবাদের নকুলেশ্বর সরকার কৃত জবাব নিম্নরূপ:
চিতান তখন বৃন্দার মুখে নিন্দা শুনে রাগে রাগে শীগোবিন্দ কয়।
পাড়ন ও তুই রক্ষক হয়ে ভক্ষক হলি তক্ষকের মতো অযুক্তি যতো করলি অভিনয় ॥
১ম ফুকার যেদিন শ্রীরাধিকার দুর্জয় মানে পায় না শ্যাম মানসাগরে বৃন্দা ভেলা সমতুল। বৃন্দা ভেলা সমতুল। যোগী সাজায়ে তারে আনিলেন কুঞ্জের দ্বারে এখন সেই বৃন্দা চিনে না তারে, কবির এই কল্পনাই ভুল ॥
২য় ফুকার ও তুই রাধার মন ভাঙ্গিবার ছলে আমাকে যোগী সাজালি কতো সান্ত্বনা দিলি। রাইকে কও মান করিতে আমায় কও পায়ে ধরিতে যেমন আগুন দিয়ে খড়কুটাতে পেতনি তুই সরে দাঁড়ালি।
মিশ ও তুই ছল করে সাজালি আমায় নবীন যোগীর সাজ সাজের ভালো মন্দ বেশকারীর কাজ আমি কি নিজের হাতে সেজেছি।
মুখ বৃন্দা তুই করে ছলা দিলি আচলাঝোলা হাড়ের মালা তাইতো পরেছি ॥
প্যাঁচ বললে কাইল গিয়েছে পৌর্ণমাসী, কার কুঞ্জে ছিলাম উপবাসী এ কথা বলো অকারণ। আমি উপবাসী থাকবো কেন থাকতে আয়োজন। আমি শেষ করে গোষ্ঠখেলা আসিতে সন্ধ্যাবেলা দেখা চন্দ্রার বাড়ি সাধুর মেলা সেখানে মহাপ্রসাদ পেয়েছি। মিশ দেখে তোমার মলিন মুখ, দুঃখে বুক ফাটে ॥
৩য় ফুকার বললে, দায় ঠেকে বৈরাগী নাছাড়, স্বীকার হই বৃন্দে রূপসী ঠেকে হলেম সন্ন্যাসী। তুই পারো দায় ঠেকাতে, তুই পারো দায় মেটাতে এসব কুটিল বিদ্যায় এ জগতে বৃন্দা তুই নারদের মাসী ॥
৪র্থ ফুকার বললে, নাই তোমার করঙ্গ দণ্ড, কোন ভণ্ডে নিয়েছে লুটি তুই এই কুচক্রের ঘুটি। তই যখন নিজের করে যোগী সাজালি মোরে যদি সাজে কোনো অভাব পড়ে, সেটা তো বেশকারীর ত্রুটি ॥
৫ম ফুকার দিলে চোরের নৌকায় সাধুর নিশান, তাই শুনে হয়েছি অবাক। ও তুই বক সাজালি কাক। দুর্জয় মান করলো রাধে, ধরা দেই সাধে সাধে দিয়ে শ্রীরাধার চরণ গারদে এই চোরকে বন্দী করে রাখ ॥
ছুট্টি ও তুই ছল করে সাজালি আমায় নবীন যোগীর সাজ সাজের ভালো মন্দ বেশকারীর কাজ আমি কি নিজের হাতে সেজেছি ।
৮ [ * নিশিকান্ত সরকার এবং নকুলেশ্বর সরকারের গান দুটি দীনেশচন্দ্র সিংহের সংকলন থেকে নেওয়া, তবে অন্যান্য গানের সঙ্গে সঙ্গতি রাখতে গিয়ে তুকনামে কিছু পরিবর্তন করা হয়েছে। দীনেশচন্দ্র সিংহ, পূর্ববঙ্গের কবিগান সংগ্রহ ও পর্যালোচনা, পৃ. ৪৮২-৮৩। ]
সূচনা পর্ব থেকে সখীসংবাদ কবিগানের জনপ্রিয় একটি অংশ। এই জনপ্রিয়তার কারণে অনেক সময়ে শুধু সখীসংবাদ গানই সাধারণের নিকট স্বতন্ত্র পরিচয় লাভ করতে শুরু করে। এর একটি বড়ো প্রমাণ উনিশ শতকে শেষ দিকে কুষ্টিয়া অঞ্চলে প্রচলিত একটি প্রবাদ। প্রবাদটি হলো: “ঘোমটার মধ্যে সখীসংবাদ”। লম্পটের সতীপনা বোঝাতে এই প্রবাদ ব্যবহৃত হতো। মীর মশাররফ হোসেন তার একটি রচনায় প্রবাদটি উদ্ধৃত করেন।” প্রবাদটির তাৎপর্য যাই হোক না কেন, এতে অন্তত এ বিষয়টি প্রমাণিত হয় যে, সখীসংবাদ নামের গানগুলো সমকালে বিশেষ জনপ্রিয় ছিলো এর বিষয়বস্তু সম্পর্কে সকলে অবগত ছিলো।
মধ্যযুগের বৈষ্ণব সাহিত্যের মতো সখীসংবাদকে নির্দ্বিধায় বৈষ্ণব সাহিত্য হিসেবে অভিহিত করা যায়। একইভাবে অন্যান্য শ্রেণির বৈষ্ণব সাহিত্যে প্রাসঙ্গিকভাবে যেমন লেখকদের জীবনবোধ রাধাকৃষ্ণের উপরে আরোপিত হয়, সখীসংবাদকে তার থেকে আলাদা ভাবার কোনো কারণ নেই।
![সখীসংবাদ বা সখী সংবাদ [ Shokhi Shongbad of Kavigan, Kobi Gaan, Kobi Lorai or Kabigan ] 5 সখীসংবাদ [ কবিগানের স্বরূপ ও প্রকৃতি ] স্বরোচিষ সরকার](https://musicgoln.com/wp-content/uploads/2021/08/Music-GOLN-11-300x157.jpg)
লেখক :
স্বরোচিষ সরকার [ Shorochish Sarkar]
বিশিষ্ট আভিধানিক ও বৈয়াকরণ
অধ্যাপক, ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ।
লেখক : কবিগানের স্বরূপ ও প্রকৃতি
এই বিষয়ে অন্য গুরুত্বপূর্ণ আর্টিকেলগুলো দেখুন :
এ বিষয়ে অন্যান্য লিংক:
- উইকিপিডিয়া : কবিগান
20 thoughts on “সখীসংবাদ বা সখী সংবাদ [ Shokhi Shongbad of Kavigan, Kobi Gaan, Kobi Lorai or Kabigan ]”