লালনকথা, লালন শাহ, লালন সাঁই এই জীবনী [ Short Biography of Lalon, Lalon Shai, Lalon Shah ]

লালনকথা, লালন শাহ, লালন সাঁই এই জীবনী [ Short Biography of Lalon, Lalon Shai, Lalon Shah ] : কুষ্টিয়া শহরের অদূরে ছেঁউড়িয়া একটি ছায়াঘেরা নিবিড় গ্রাম। একপাশে গড়াই অন্যপাশে কালিগঙ্গা দু’টি বহমান নদী। আজ থেকে প্রায় দুইশত সতের বছর আগের একদিন ভোরবেলা ষোল-সতের বছরের অচেতন লালন ভাসতে ভাসতে কালিগঙ্গা নদীর তীরে এসে ভিড়ল। ছেঁউড়িয়া গ্রামের মওলানা মলম কারিকর নামাজি লোক। তাঁর পিতা মুন্সি খায়রুল্লাহ্। মুন্সি খায়রুল্লাহ্র চার পুত্র মলম, আলম, কলম ও তিলম কারিকর।

আলম কারিকর ছাড়া মলমের মতোই অপর দুইভাই কলম ও তিলম নিঃসন্তান ছিলেন। মলম ছোট বেলাতেই নামাজ এবং ইসলামী ভাবধারায় মনোযোগী হয়ে পড়েন। পরবর্তীতে তিনি কুষ্টিয়ার একটি প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসায় ভর্তি হন এবং সেখান থেকে কোরানে হাফেজ ও মৌলানা পাশ করেন। হাফেজ মলম নিজে সুশিক্ষিত ছিলেন। বিনয় এবং মার্জিত ব্যবহারের কারণে সকলে তাঁকে সমান শ্রদ্ধা করতো। তাঁর এই সুনাম ছেঁউড়িয়া ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ে আশেপাশের গ্রামে।

 

লালনকথা, লালন শাহ, লালন সাঁই এই জীবনী [ Short Biography of Lalon, Lalon Shai, Lalon Shah ]

 

লালনকথা, লালন শাহ, লালন সাঁই এই জীবনী [ Short Biography of Lalon, Lalon Shai, Lalon Shah ] - লালন শাহ'র জীবদ্দশায় তৈরি করা একমাত্র চিত্র, ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে এঁকেছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর : Lalon sketch by Jyotirindranath Tagore
লালন শাহ’র জীবদ্দশায় তৈরি করা একমাত্র চিত্র, ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে এঁকেছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর

মলম বাইশ বছর বয়সে গড়াই নদীর ওপাড়ের কয়া গ্রামের এক তন্তুবায়ী ধার্মিক পরিবারের বারো বছরের সুদর্শনা কন্যা মতিজানকে বিবাহ করেন। স্বামীর প্রতি যত্নশীলা মতিজানের কণ্ঠ ছিলো ভারী মিষ্টি। রুচিশীলা এই রমনী সবকিছু গুছিয়ে রাখতেন। মিষ্টি সুরে কোরান পাঠ করতেন। ভারী সুন্দর তাদের ঘর দোর সংসার। এতো কিছুর পরও তাদের দু’জনের ভিতর ছিলো সন্তানহীন এক শূন্যতা। সন্তানের কামনায় পার হয়ে গেলো একযুগেরও বেশী সময়। সেদিন ভোরবেলা মওলানা মলম ফজরের নামাজ পড়ে কালিগঙ্গা নদীর দিকে হাওয়া খেতে আসলেন, হঠাৎই দেখতে পেলেন এক অচেনা সংজ্ঞাহীন যুবক অর্ধজলমগ্ন অবস্থায় পড়ে আছে, ছেলেটির মুখে ও শরীরে বসন্ত রোগের দাগ বিদ্যমান। তিনি কাছে গিয়ে দেখলেন ছেলেটি বেঁচে আছে, খুব ধীরলয়ে চলছে শ্বাস-প্রশ্বাস ।

নিঃসন্তান হাফেজ মলমের বুকের ভেতর হু হু করে উঠলো, এ কোনো অচেনা যুবক নয়; খোদা যেন তাঁর সন্তানকেই ভাসিয়ে এনেছেন তাঁর কাছে। মলম তৎক্ষণাৎ বাড়ী ফিরলেন এবং তাঁর অপর তিন ভাইকে সাথে নিয়ে আসলেন। এবার চার ভাইয়ে ধরাধরি করে অচেতন যুবককে নিজের বাড়ীতে আনলেন। মলম ও মতিজান দিনরাত পরম যত্নে সেবা করতে লাগলেন। দিনে দিনে অচেনা যুবকটির মুখে জীবনের আলো ফিরে এলো।

মতিজান জিজ্ঞাসা করলো-বাবা তোমার নাম কি?
—–ফকির লালন।

আমৃতুৎ ফকির লালন ছেঁউড়িয়াতেই ছিলেন, মৃত্যুর পর ছেঁউড়িয়ার আঁখড়াবাড়ীতেই তার সমাধি নির্মিত হয়। ছেঁউড়িয়াভিত্তিক লালনের জীবনবৃত্তান্ত বিস্তারিতভাবে খুঁজে পাওয়া যায় ফকির আনোয়ার হোসেন মন্টু শাহের সম্পাদিত লালন সংগীত নামক গ্রন্থে।

লালন সাঁই মাজার ছেউড়িয়া, কুমারখালী, কুষ্টিয়া
লালন সাঁই মাজার ছেউড়িয়া, কুমারখালী, কুষ্টিয়া

লালন কোথায় ছিলো, কিভাবে কালিগঙ্গা দিয়ে ভেসে আসলো এসব বিষয়ে যে তথ্য পাওয়া যায় তা সর্বজনগ্রাহ্য নয়। কথিত আছে গঙ্গাস্নান সেরে ফেরার পথে লালন বসন্তরোগে গুরুতরভাবে অক্রান্ত হয়ে পড়েন। রোগের প্রকোপে অচেতন হয়ে পড়লে সঙ্গীসাথীরা তাঁকে মৃত মনে করে রোগ সংক্রমণের ভয়ে তাড়াতাড়ি মুখাগ্নি করে নদীতে ফেলে দেয়।

লালনের জন্ম আসলে কোথায় তা আজো নিশ্চিত করে বলা যায়না। কোন কোন লালন গবেষক মনে করেন লালন কুষ্টিয়ার কুমারখালী থানার চাপড়া ইউনিয়নের অন্তর্গত ভাড়ারা গ্রামে জন্মেছিলেন। এই মতের সাথে অনেকেই দ্বিমত পোষণ করেন এই বলে যে, ছেঁউড়িয়া থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরের ভাড়ারা গ্রামের ষোল সতের বছরের একটি যুবক নিখোজ হলো অথচ তাঁর দীর্ঘ জীবদ্দশায় তাকে তার কোন আত্মীয়-স্বজন কিংবা পরিচিতজন কেউ চিহ্নিত করতে পারলোনা-তা এক বিস্ময়কর ব্যাপার।

১৩৪৮ সালের আষাঢ় মাসে প্রকাশিত মাসিক মোহাম্মদী পত্রিকায় এক প্রবন্ধে লালনের উল্লেখ করা হয় “লালনের জন্ম যশোর জেলার ফুলবাড়ী গ্রামের মুসলিম পরিবারে”। অন্যদিকে পাজুশাহের ছেলে খোন্দকার রফিউদ্দিন তাঁর ভাবসংগীত নামক গ্রন্থে ফকির লালনের জন্মবৃত্তান্ত বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন – ফকির লালন শাহের জন্মভূমি যে যশোর জেলার হরিণাকুন্ডু থানার অধীন হরিশপুর গ্রামেই ছিলো, ইহাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। লালনের জন্মস্থান সম্পর্কে লালন গবেষক ডঃ আনোয়ারুল করিমের ধারণাটি ছিলো অনবদ্য

“আমি দীর্ঘ ২০ বছর লালন ফকিরের জীবনী সংক্রান্ত বিষয়ে তথ্যানুসন্ধান করে বেড়িয়েছি।
কিন্তু তাঁর জাতিত্ব অথবা জন্মস্থান সম্পর্কে সঠিক কোন সিদ্ধান্তে আজো উপনীত হতে পারিনি”।।

লালন সাঁই মাজার গেট [রাত] ছেউড়িয়া, কুমারখালী, কুষ্টিয়া
লালন সাঁই মাজার গেট [রাত] ছেউড়িয়া, কুমারখালী, কুষ্টিয়া
মূলত লালনের জন্ম পরিচয় রহস্যময়। আসলে লালন নিজেও তাঁর জন্ম পরিচয় প্রদান করতে উৎসাহবোধ করেননি, তা তাঁর গানেই স্পষ্টমান –

সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে।
লালন কয় জাতের কিরূপ দেখলাম না এই নজরে।।

সত্যিই তাই, জাতপাতের উর্দ্ধে উঠে লালন নিজেকে শুধুই মানুষ হিসেবে পরিচয় দিয়ে গেছেন।

লালন হিন্দু কি মুসলমান এনিয়েও বিস্তর মতামত পাওয়া যায়। কারো মতে লালন কায়স্থ পরিবারের সন্তান যার পিতা মাধব এবং মাতা পদ্মাবতী; পরে লালন ধর্মান্তরিত হন। গবেষকদের মধ্যে বেশীরভাগই মনে করেন লালন মুসলিম তন্তুবায় পরিবারের সন্তান। তাঁর পিতার নাম দরিবুল্লাহ দেওয়ান, মাতার নাম আমিনা খাতুন। লালন ফকির নিজের জাতপরিচয় দিতে গিয়ে বলেছেন—

সবে বলে লালন ফকির কোন জাতের ছেলে।
কারে বা কী বলি আমি
দিশে না মেলে।।

রোগমুক্তির পর লালন সাঁই [ Lalon Sai after recovery ] :

রোগমুক্তির কিছুদিন পর লালন ফকির বিদায় চাইলেন, বললেন আমি সংসারত্যাগী মানুষ; এই ভবসংসারে আমার ঠাঁই নাই। কথিত আছে লালন অলৌকিকভাবে হেঁটে কালিগঙ্গা নদী পার হয়ে যায়। পরে অবশ্য মলম ডিঙি নৌকা নিয়ে পার হয়ে প্রায় দৌড়ে গিয়ে লালনকে ধরে ফেলে এবং ছেঁউড়িয়া ফিরে যাবার জন্য ব্যাথিত হৃদয়ে অনুরোধ করে। লালন কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলে যে, যেতে পারি তবে আমার জন্য আলাদা জায়গার ব্যবস্থা করতে হবে।

নিঃসন্তান মলম তাঁর প্রিয় সন্তানের কথা রাখলেন। কালিগঙ্গা নদীর তীরে শ্যামল বৃক্ষমন্ডিত মলমের বাগানে তৈরী হলো চৌচালা ঘর আর আঁখড়াবাড়ী। চৌচালা ঘরটি লালন সাধনকক্ষ হিসেবে ব্যবহার করতেন। কালের নিয়মে ছনের ঘরটি বিলীন হয়ে গেলেও মহান সাধক লালনের পরশমাখা সাধনকক্ষের কপাটজোড়া এবং জলচৌকি এখোনো লালন একাডেমির যাদুঘরে রাখা আছে।

এই আঁখড়াবাড়ীটিই ক্রমে সাধন ভজনের পূন্যধামে পরিণত হয়। ফজরের নামাজের পর মাওলানা মলম কোরান তেলওয়াত করতেন, ফকির লালন মনোযোগ দিয়ে তেলওয়াত শুনতেন, মানে জিজ্ঞাসা করতেন। লালন কোরানের কিছু কিছু আয়াতের আধ্যাতিক ব্যাখ্যা করতেন, ব্যাখ্যা শুনে মাওলানা মলম অভিভূত হয়ে যেতেন।

লালনের প্রতি অপরিসীম ভক্তি ও অনুরাগে অনুপ্রাণিত হয়ে এক সময় মলম ও মতিজান লালনের কাছে দীক্ষা গ্রহণ করে। মলম কারিকর থেকে হয়ে যান ফকির মলম শাহ্ অন্যদিকে মতিজান হয়ে যান মতিজান ফকিরানী। ফকির মলম শাহ্ ছিলেন সর্বাপেক্ষা বয়োজৈষ্ঠ শিষ্য। মলমের অপর দুইভাই কলম ও তিলম সস্ত্রীক পর্যায়ক্রমে লালনের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন।

লালনের মুখে বসন্তের দাগ ছিলো, তাঁর হাত দুটো এতো লম্বা ছিলো যে দাঁড়ালে আঙ্গুলগুলো হাঁটুর নীচে পড়তো। উঁচু নাক, উন্নত কপাল আর গৌরবর্ণের লালনের ছিলো গভীর দৃষ্টিসম্পন্ন চোখ। কাঁধ বরাবর বাবরী চুল, লম্বা দাড়ী, হাতে ছড়ি, পায়ে খড়ম, গায়ে খেল্‌কা, পাগড়ী, আঁচলা, তহবন-সব মিলিয়ে লালন যেন এক সিদ্ধপুরুষ, পরিপূর্ণ সাধক।

লালন সাঁই মাজারে গাইছেন ভক্ত, ছেউড়িয়া, কুমারখালী, কুষ্টিয়া
লালন সাঁই মাজারে গাইছেন ভক্ত, ছেউড়িয়া, কুমারখালী, কুষ্টিয়া

লালন মুখে মুখেই গানের পদ রচনা করতেন। তাঁর মনে নতুন গান উদয় হলে তিনি শিষ্যদের ডেকে বলতেন— ‘পোনা মাছের ঝাঁক এসেছে’। লালন গেয়ে শোনাতেন, ফকির মানিক ও মনিরুদ্দিন শাহ্ সেই বাঁধা গান লিখে নিতেন। লালনের জীবদ্দশাতেই তাঁর গান বহুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিলো। ফকির মানিক শাহ্ সেই সময়ের একজন শ্রেষ্ঠ গায়ক ছিলেন। লালনের শিষ্যদের ধারণা তার গানের সংখ্যা দশ হাজারেরও বেশী। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এতো বিপুল সংখ্যক গান পাওয়া যায়না। শোনা যায় লালনের কোন কোন শিষ্যের মৃত্যুর পর গানের খাতা তাদের কবরে পুঁতে দেয়া হয়। এছাড়াও অনেক ভক্ত গানের খাতা নিয়ে গিয়ে আর ফেরত দেননি।

ছেঁউড়িয়ায় কয়েক বছর থাকার পর লালন তাঁর শিষ্যদের ডেকে বললেন, আমি কয়েক দিনের জন্য বাইরে যাচ্ছি তোমরা আমার সাধন কক্ষটার দেখাশুনা করো। সপ্তাহ তিনেক পর তিনি একটি অল্পবয়স্কা সুশ্রী যুবতিকে নিয়ে ফিরলেন।

মতিজান ফকিরানী জিজ্ঞাসা করলেন, মেয়েটি কে বাবা?
-তোমাদের গুরুমা।

একথা শোনার পর আঁখড়াবাড়ীর সকলেই গুরুমাকে ভক্তি করলেন। বিশখা নামের এই মেয়েটি সারাজীবন লালনের সাথে ছিলেন। লালনের মৃত্যুর তিনমাস পর সেও মারা যায়। বিশখা ফকিরানী প্রায় একশো বছর ধরে ছেঁউড়িয়ায় ছিলেন কিন্তু তাঁর প্রকৃত নাম পরিচয় জানা যায়নি। এমনকি মৃত্যুর পরও তাঁর কোন আত্মীয় বা পরিচিতজনকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। অচিন মানুষ ফকির লালনের মতোই বিশখা ফকিরানী আজো এক অচিন নারী।

ফকির লালন একদিন তাঁর সাধন ঘরে একা একা বসেছিলেন। এমন সময় খোসা থানার কমলাপুর গ্রামের দুইজন ভক্ত এসে জানালেন যে তাদের গ্রামে কলেরা লেগেছে, সেখানকার ভক্ত ফকির রহিম শাহ্ তাঁর নাবালক পুত্র এবং স্ত্রীকে রেখে কলেরা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। সব শুনে লালন খুব মর্মাহত হলেন। ফকির রহিম শাহের নাবালক পুত্র শীতলকে নিজের কাছে নিয়ে আসলেন। বিশখা ও লালন তাকে পুত্র স্নেহে লালন পালন করতে লাগলেন।

অন্যদিকে বেশ কয়েক বছর পর ফকির শুকুর শাহ্ তাঁর মাতৃহারা কন্যাকে লালনের কাছে নিয়ে আসেন, লালন সস্নেহে তাকে কোলে তুলে নিলেন এবং বিশখাকে বললেন-আজ থেকে এই শিশুটিও তোমার কন্যা। পরীর মতো সুন্দর এই মেয়েটিকে লালন পরী না বলে প্যারিনেছা বলে ডাকতেন। ভোলাই শাহ্ লালনের একান্ত শিষ্যদের অন্যতম, বাল্যকাল থেকেই সে আর শীতল একই ঘরে থাকতেন। ভোলাই শাহ বড় হয়ে কোন এক দোল পূর্ণিমার রাতে প্যারীনেছার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।

লালন সাঁই মাজারে ভক্তবৃন্দের সমাধি, ছেউড়িয়া, কুমারখালী, কুষ্টিয়া
লালন সাঁই মাজারে ভক্তবৃন্দের সমাধি, ছেউড়িয়া, কুমারখালী, কুষ্টিয়া

ফকির লালনকে নিয়ে বেশ কিছু কিংবদন্তী প্রচলিত আছে। একবার লালন তাঁর শিষ্যদের নিয়ে গঙ্গানদী পার হয়ে নবদ্বীপ গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর ধামে পৌঁছলেন। মন্দিরের লোকজন আগন্তকদের অদ্ভুত বেশভূষা দেখে তাদের পরিচয় জিজ্ঞাসা করলো, লালনশিষ্য শীতল শাহ বললো আমরা কুষ্টিয়া থেকে এসেছি, সকলেই ফকির মতবাদের সাধক। তখন মহাপ্রভুর কাছে গিয়ে বলা হলো যে কুষ্টিয়া থেকে কিছু সাধক ফকির এসেছে যাদের বেশিরভাগ মুসলমান। মহাপ্রভু সবশুনে তাদের বসার ব্যবস্থা করতে বললেন।

আঙিনার একপাশে বড় নিমগাছের তলায় তাদের জায়গা করে দেয়া হলো। সারারাতের অনুষ্ঠান শেষে সাধুগুরু এবং বোষ্টমিদের সেবা দেওয়ার পর তাদের পালা এলো। যুবকেরা পিতলের থালায় করে সোয়া সের চুন নিয়ে এলো এবং সবাইকে বললো হাত পাতুন, মহাপ্রভূর প্রসাদ গ্রহণ করুন। চুনে মুখ পুঁড়ে যাবে এই ভয়ে শিষ্যরা কেউ হাত পাতলোনা বরং একযোগে ক্ষমা চাইলো। যুবকেরা বললো আপনারা কেমন সাধু! চুনে মুখ পুঁড়ে যাবার ভয়ে কেউ হাত পাতলেন না। প্রকৃত সাধুদের তো মুখ পোড়ার কথা নয়! লালন এক কোণায় বসেছিলেন, যুবকদের এই কথা শুনে বললো তোমরা কি চাও?

-তোমরা কেমন সাধু হয়েছো তা দেখতে চাই।

লালন যুবকদের কলার পাতা এবং একটি চাড়ি আনতে বললো। অতঃপর তিনি খানিক চুন কলা পাতায় রেখে বাকি চুন চাড়ি ভর্তি পানিতে গুলিয়ে দিলেন। এবার তিনি নিজেই কলাপাতার চুনগুলো খেয়ে ফেললেন এবং শিষ্যদের চাড়ি থেকে গ্লাসে করে চুনগোলানো শরবত খাওয়ালেন। তাঁরা সকলেই শরবত পানের তৃপ্তি লাভ করলো। এই শরবত পান চুনসেবা নামে পরিচিত।

লালন ঘোড়ায় চড়তেন, মাঝে মাঝে গভীর রাতে চাঁদের আলোতে ঘোড়ায় চড়ে ঘুরে বেড়াতেন, কোথায় নিরুদ্দেশ হয়ে যেতেন তা তাঁর শিষ্যরা কেউ বলতে পারতোনা।

লালন একাডেমির খাদেম নিজাম উদ্দিনের বয়স বর্তমানে ৮৫ বছর, তাঁকে লালন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে সে জানায় আমার দাদাগুরু ভোলাই শাহের কাছে শুনেছি লালন রাতের বেলা দুধ দিয়ে খই ভিন্ন অন্য কোন খাদ্য খেতেন না। প্রায় সারারাত জেকের আসকার ও এবাদত করতেন, একটু পর পর পান খেতেন। তখন আঁখড়াবাড়ীতে পানের বরজ এবং অনেক ঝোপজংগল ছিলো। ভক্তরা ভারতের গয়া থেকে ফকির লালনের জন্য চুন নিয়ে আসতো, সেই চুনে তিনি পান খেতেন।

এই প্রসঙ্গে তিনি আরো জানান যে, নবদ্বীপ থেকে এখনো কিছু কিছু লালনভক্ত আঁখড়ায় আসে, তাদের কাছে সে শুনেছে যে নবদ্বীপে গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর ধামে লালন ও তাঁর শিষ্যেেদর যে চুনসেবা দেয়া হয়েছিলো সেই চুনসেবায় লালনের যে আসন পাতা ছিলো তা এখনো সংরক্ষিত আছে। নিজামুদ্দিনের ধারণা, হয়তো দোল পূর্ণিমার তিথিতে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন বলেই লালন তাঁর জীবদ্দশায় ফাগুন মাসের দোল পূর্ণিমার রাতে খোলা মাঠে শিষ্যদের নিয়ে সারারাত ধরে গান বাজনা করতেন।

লালন সাঁই মাজারে প্রবেশের রাস্তা, ছেউড়িয়া, কুমারখালী, কুষ্টিয়া
লালন সাঁই মাজারে প্রবেশের রাস্তা, ছেউড়িয়া, কুমারখালী, কুষ্টিয়া

সেই ধারাবাহিকতায় এখনো লালন একাডেমি প্রতি বছর ফাগুন মাসের দোল পূর্ণিমার রাতে তিনদিন ব্যাপী স্মরণোৎসবের আয়োজন করে থাকে। লালন চতুর ছাড়াও আঁখড়ার অভ্যন্তরভাগসহ সর্বত্র দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসা হাজার হাজার বাউলরা ছোট ছোট দলে সারারাত ধরে গান করে । এছাড়াও প্রতি বছর ১লা কার্তিকে লালনের মৃত্যু দিবস উপলক্ষে অনুরূপ উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। দেশ বিদেশের হাজার হাজার বাউল যোগ দেয় সেই উৎসবে, দোল পূর্ণিমার জোস্নায় বাউলরা আকাশের দিকে হাত তুলে গান ধরে —-

এলাহি আল আমিনগো আল্লাহ বাদশা আলমপানা তুমি।
ডুবাইয়ে ভাসাইতে পারো, ভাসাইয়ে কিনার দাও কারোও
রাখো মারো হাত তোমার, তাইতে তোমায় ডাকি আমি।।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে লালনের যথেষ্ঠ সখ্যতা ও ভাববিনিময় ছিলো। জমিদারীর তাগিদেই রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহের কুঠিবাড়ীতে থাকতেন, পদ্মার পাড়ের নির্জনতায় বসে কাব্য রচনা করতেন। ফকির লালনের সাথে যখন তাঁর পরিচয় ঘটে তখন তিনি বয়সে তরুণ। তিনি একবার লালনের আখড়ায় এসেছিলেন, গভীর অথচ সহজ ভাষায় বাঁধা লালনের গান তাঁকে মুগ্ধ করেছিলো, সেই থেকেই তাদের মধ্যে ভাবের লেনদেন।

রবীন্দ্রনাথ কোথাও যেতে হলে পালকি ব্যবহার করতেন, লালন ফকির ঘোড়ায় চড়তেন। লালন ফকির ঘোড়ায় চড়েই কুঠিবাড়ীতে দু-একবার এসেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ মাঝে মাঝেই তাঁর বোট নিয়ে পদ্মায় ঘুরে বেড়াতেন। রবীন্দ্রনাথের সেজদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর বোটে বসা ভ্রমণরত ফকির লালনের একটি স্কেচ এঁকে ফেলেন যার একটি কপি এখনো লালন একাডেমির মিউজিয়ামে রক্ষিত আছে।

লালন ফকির ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মধ্যে যে গভীর ভাববিনিময় ছিলো তার একটি তথ্যবহুল বিবরণ পাওয়া যায় আবুল আহসান চৌধুরী রচিত ‘লালন সাঁইয়ের সন্ধানে’ নামক গবেষণামূলক গ্রন্থে। লালনের গান রবীন্দ্রনাথকে কিভাবে প্রভাবিত করেছিলো তা তাঁর কবিতা পাঠ করলেই বোঝা যায়।

তরুণ যৌবনের বাউল
সুর বেঁধে নিলো আপন একতারাতে,
ডেকে বেড়ালো
নিরুদ্দেশ মনের মানুষকে
অনির্দেশ্য বেদনার খেপা সুরে।

কবিতায় নয়, রবীন্দ্রনাথের বেশভূষাতেও এসেছিলো অনবদ্য এক বাউলপনা। আলখেল্লা পরা বাবরী চুলের শশ্রুমন্ডিত রবীন্দ্রনাথ যেন বাউল বেশে লিখে চলেছেন—
একলা প্রভাতের রৌদ্রে সেই পদ্মানদীর ধারে,
যে নদীর নেই কোনো দ্বিধা পাকা দেউলের পুরাতন ভিত
ভেঙে ফেলতে।’

লালন সাঁই মাজারের আভ্যন্তরে, ছেউড়িয়া, কুমারখালী, কুষ্টিয়া
লালন সাঁই মাজারের আভ্যন্তরে, ছেউড়িয়া, কুমারখালী, কুষ্টিয়া

একদা শান্তিনিকেতনে ফিরে যাবার পর প্রসঙ্গক্রমে রবীন্দ্রনাথ কালীমোহন ঘোষকে বলেছিলেন ‘তুমিতো দেখেছো শিলাইদহতে লালন শাহ ফকিরের শিষ্যদের সহিত ঘন্টার পর ঘন্টা আমার কিরূপ আলাপ জমত। পরিচ্ছদ নাই। দেখলে বোঝবার জো নাই তারা কতো মহৎ। কিন্তু কত গভীর বিষয় কত সহজভাবে তারা বলতে পারতো।

এ থেকেই বোঝা যায় তিনি তাঁর উপলব্ধি দিয়ে কিভাবে শ্রদ্ধা করতেন, লালন ও তাঁর বাউল সমাজকে। রবীন্দ্রনাথ নিজেও অনেক জায়গায় বলেছেন-তাঁর অনেক গানেই লালনের ভাবধারা বিদ্যমান আছে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই প্রথম লালনের গান সংকলন করেন ।

গভীর জ্ঞানের অধিকারী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গভীরভাবেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন ফকির লালন এবং তাঁর গানকে। তাইতো অঁজো পাড়াগাঁর সমাজবঞ্চিত ফকির লালন এবং তাঁর গরীব শিষ্যরা উঠে এসেছে তাঁর গানে, কবিতায়-উপন্যাসে।

লালন দর্শনের একটি অন্যতম দিক হলো গুরুবাদ। শুরুর প্রতি ভক্তি নিষ্ঠাই হলো তাদের শ্রেষ্ঠ সাধনা। ধ্যান ছাড়া যেমন গুরুকে ধারণ করা যায়না তেমন গুরুর প্রতি অসামান্য ভক্তি ছাড়া অন্তরাত্মা পরিশুদ্ধ হয়না। মানুষের প্রতি ভালোবাসা, জীবে দয়া, সত্য কথা, সৎ কর্ম, সৎ উদ্দেশ্য এই হলো গুরুবাদী মানবধর্মের মূল কথা । মূলত ভক্তিই মুক্তি

ভবে মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার ।
সর্ব সাধন সিদ্ধ হয় তার।।

যারা হাওয়ার সাধনা করে তারাই মূলত বাউল, তাদের মতে সাধনার চারটি স্তর আছে-স্থুল, প্রবর্ত, সাধক ও সিদ্ধ। প্রথম পর্যায়ের শিক্ষা হলো স্কুল, দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রবর্ত, তৃতীয় পর্যায়ে সাধক এবং চতুর্থ বা চুড়ান্ত পর্যায়ের শিক্ষা হলো সিদ্ধ। লালনের গানেও দেখা যায় সেই ভাবদর্শন—

ধর চোর হাওয়ার ঘরে ফাঁদ পেতে।
সেকি সামান্য চোরা
ধরবি কোণা কানচীতে ।।

লালন তাঁর অসংখ্য গানের মধ্য দিয়ে পরিশুদ্ধ আত্মার অনুসন্ধান করেছেন, তার গানে ও ভাবাদর্শে সুফিবাদের ভাবধারা স্পষ্ট হয়ে ওঠে –

আপনার আপনি চেনা যদি যায় ।
তবে তারে চিনতে পারি
সেই পরিচয়।।

লালনের ভাবশিষ্যরা বিশ্বাস করে যে শারিরীক প্রেম ভালোবাসার মধ্যে প্রকৃত শান্তি নেই; প্রকৃত শান্তি আছে স্বর্গীয় ভালোবাসায়। গুরুর নিকট ক্ষা গ্রহণের পর সাধনার বিশেষ স্তরে পৌঁছুলেই কেবল শিষ্যকে খেলাফত প্রদান করা যায়। লালনের অনুসারীরা বিবাহ এবং স্ত্রী সম্ভোগ করতে পারে কিন্তু তাদের বিশ্বাস সন্তান উৎপাদনের ফলে আত্মা খন্ডিত হয়, আর খন্ডিত আত্মা নিয়ে খোদার নৈকট্য লাভ করা যায়না। সেই কারণেই তারা সন্তান উৎপাদন থেকে বিরত থাকেন। তাছাড়া সন্তান উৎপাদনকে তাঁরা বেদনাদায়ক বোঝা হিসেবেও বিবেচিত করে।

লালন সাঁই মাজারের বাইরের বাজার, ছেউড়িয়া, কুমারখালী, কুষ্টিয়া
লালন সাঁই মাজারের বাইরের বাজার, ছেউড়িয়া, কুমারখালী, কুষ্টিয়া

খেলাফতের ধারণাটি ইসলামী সুফিজম থেকে এসেছে-যার মূলকথা আধ্যাতিক সাধনার মাধ্যমে আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে খোদার নৈকট্য লাভ করা যায়। সুফিবাদে সাধনার দুটি পর্যায় হলো বাকাবিল্লাহ এবং ফানাফিল্লাহ। বাকাবিল্লাহ মানে খোদার অপার ভালোবাসা, অন্যদিকে ফানাফিল্লাহ হলো আত্মার ভিতর খোদাকে ধারণ করা। বাকাবিল্লাহ ও ফানাবিল্লাহ অর্জন করার জন্য প্রয়োজন আত্মার পরিশুদ্ধি। খেলাফত অর্জনের পর একজন সাধক সকল পার্থিব বিষয় থেকে নির্মোহ হয়ে উঠেন। পুরুষরা সাদা আলখেল্লা এবং সাদা লুঙ্গি পরে অন্যদিকে মেয়েরা সাদা শাড়ী পরে, যাকে তারা বলে খিলূকা।

খিলুকা হলো কাফন সদৃশ পোষাক তাদের ভাষায় জিন্দাদেহে মুর্দার পোষাক। খেলাফত প্রদানের সময় খেলাফত গ্রহণকারীকে চোখে সাদা কাপড় বেঁধে খিল্‌কা গায়ে লালনের সমাধিকে কেন্দ্র করে সাতবার প্রদক্ষিণ করতে হয়। এ সময় তাঁরা লালনের একটি বিশেষ গান গাইতে থাকে –

কে তোমারে এ বেশ-ভূষণ পরাইল বল শুনি।
জিন্দাদেহে মুরদার বেশ,
খিলূকা তাজ আর ডোর কোপনী।।

লালন সাঁই মাজারের গাইছেন ভক্তবৃন্দ, ছেউড়িয়া, কুমারখালী, কুষ্টিয়া
লালন সাঁই মাজারের গাইছেন ভক্তবৃন্দ, ছেউড়িয়া, কুমারখালী, কুষ্টিয়া

লালন ফকিরের বয়স তখন ১১৬ বছর, একদিন তিনি শিষ্যদের ডেকে বললেন, এই আশ্বিন মাসের শেষের দিকে তোমরা কোথাও যেওনা কারণ পহেলা কার্তিকে গজব হবে। গজবের বিষয়টি শিষ্যরা কেউ সঠিকভাবে অনুমান করতে না পারলেও আসন্ন বিপদের আশংকা করতে লাগলো। মৃত্যুর প্রায় একমাস আগে তাঁর পেটের ব্যারাম হয়, হাত পায়ের গ্রন্থিতে পানি জমে । পীড়িতকালেও তিনি পরমেশ্বরের নাম সাধন করতেন, মধ্যে মধ্যে গানে উম্মুক্ত হতেন। ধর্মের আলাপ পেলে নববলে বলিয়ান হয়ে রোগের যাতনা ভুলে যেতেন।

এসময় দুধ ভিন্ন অন্য কিছু খেতেন না তবে ইলিশ মাছ খেতে চাইলে শিষ্যরা বাজার থেকে ইলিশ মাছ নিয়ে আসে। দুপুরে সাধনঘরের সামনে সামিয়ানা টাঙ্গিয়ে খাওয়া দাওয়ার আয়োজন করা হয়। বিকেল থেকে শুরু করে সারারাত লালন তাঁর শিষ্যদের শ্বাশ্বত বাণী শোনান, মাঝে মাঝে গাওয়া হয় তাঁর গান। রাতে আলোচনা শেষ করে লালন সাধন ঘরে ফিরে গেলেন বিশ্রাম নিতে। শিষ্যদের বললেন, আমি চললাম। লালন চাদর মুড়ি দিয়ে বিশ্রাম নিলেন, শিষ্যরা মেঝেতে বসে থাকলেন। এক সময় লালন কপালের চাদর সরিয়ে বললেন তোমাদের আমি শেষ গান শোনাবো । লালন গান ধরলেন, গভীর অপরূপ সুন্দর গান –

পার কর হে দয়াল চাঁদ আমারে ।
ক্ষম হে অপরাধ
আমার এই ভবকারাগারে ।।

নন্দলাল বসুর আঁকা লালনের এই কাল্পনিক চিত্রই সাধারণ মানুষের কাছে অধিক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।
নন্দলাল বসুর আঁকা লালনের এই কাল্পনিক চিত্রই সাধারণ মানুষের কাছে অধিক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।

গান শেষ হলো, চাঁদর মুড়ি দিয়ে চিরদিনের জন্য নীরব হয়ে গেলেন ফকির লালন। ফকির লালনের জন্ম সাল জানা যায়নি, তিনি ১লা কার্তিক ১২৯৭ বঙ্গাব্দ মোতাবেক ১৭ অক্টোবর ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে মারা যান এবং তিনি বেঁচে ছিলেন ১১৬ বছর। সেই হিসেবে তিনি জন্মেছিলেন ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দে। ছেঁউড়িয়াতে ফকির লালনের সাথে তার পালিত মা মতিজান ফকিরানী, পালিত বাবা ফকির মলম শাহ্, ফকির পন্ডিত মানিক শাহ্, শীতল শাহ্, ভোলাই শাহ্, বিশখা ফকিরাণী এবং ফকির মনিরুদ্দিন শাহসহ অন্যান্য আরো অনেক ভাবশিষ্যের সমাধি আছে। প্রতি বছর ১লা কার্তিক এখানে দেশ-বিদেশের হাজার হাজার বাউল সমবেত হয়ে উদ্‌যাপন করে তাঁর মৃত্যুবার্ষিকী।

লালনের মৃত্যুর অব্যবহিত পরে ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে ৩১ অক্টোবর কুষ্টিয়ার রাহিনীপাড়া থেকে প্রকাশিত মীর মশাররফ হোসেনের সম্পাদনায় পাক্ষিক হিতকারী পত্রিকায় মহাত্মা লালন ফকির শিরোনামে একটি বস্তুনিষ্ট নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। নিবন্ধটি পাঠ করিলে লালন ও তাঁর শিষ্যদের জীবনধারার একটি পরিস্কার বর্ণনা পাওয়া যায়।

নিবন্ধকার লিখেছেন – কির লালনের নাম এ অঞ্চলে কাহারো শুনিতে বাকি নাই। ইহাকে আমরা স্বচক্ষে দেখিয়াছি, আলাপ করিয়া বড়ই প্রীত হইয়াছি। শুনতে পাই বঙ্গদেশ জুড়ে ইহার শিষ্য দশ হাজারের উপর। কুষ্টিয়ার অনতিদূরে কালিগঙ্গার ধারে ছেঁউড়িয়া গ্রামে ইহার একটি সুন্দর আঁখড়া আছে। আঁখড়ায় ১৫/১৬ জনের অধিক শিষ্য নাই। শিষ্যদের মধ্যে শীতল ও ভোলাই নামক দুইজনকে ইনি ঔরসজাত পুত্রের ন্যায় স্নেহ করিতেন, অন্যান্য শিষ্যগণকে তিনি কম ভালোবাসিতেন না। আঁখড়ায় ইনি সস্ত্রীক বাস করিতেন; সম্প্রদায়ের ধর্ম মতানুসারে ইহার কোন সন্তানসন্ততি হয় নাই।

শিষ্যগণের মধ্যেও অনেকের স্ত্রী আছে, কিন্তু সন্তান হয় নাই। সম্প্রতি সাধুসেৱা বলিয়া এই মতের এক নতুন সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হইয়াছে। সাধুসেবা ও বাউলের দলে যে কলঙ্ক দেখিতে পাই, লালনের সে প্রকার কিছু নাই। লালন সকল নীচ কার্য হইতে দুরে ছিলেন ও ধর্ম জীবনে বিলক্ষণ উচ্চ ছিলেন বলিয়া বোধ হয় । মিথ্যা জুয়াচুরিকে লালন ফকির বড়ই ঘৃণা করিতেন। নিজে লেখাপড়া জানিতেন না, কিন্তু তাহার রচিত অসংখ্য গান শুনলে তাহাকে পরম পণ্ডিত বলিয়া বোধ হয়।

ইহার জীবনী লিখিবার কোন উপকরণ পাওয়া কঠিন। শিষ্যরা হয়ত তাঁহার নিষেধক্রমে না হয় অজ্ঞাত বসতঃ কিছুই বলিতে পারেনা। ইহার মুখে বসন্ত রোগের দাগ বিদ্যমান ছিলো।

লালনকথা, লালন শাহ, লালন সাঁই [ Short Biography of Lalon, Lalon Shai, Lalon Shah ] লিখেছেন – এ কে এম আজাদুর রহমান।

আরও পড়ুন:

লালন দর্শন নিয়ে কথা বলেছেন তার এক ভক্ত: