রাগ ইমন

রাগ ইমন উত্তর ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের এক বিশেষ রাগ, যা সঙ্গীতশিল্পী এবং সুরকারদের কাছে অত্যন্ত প্রিয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বহু সংগীতরচনায় রাগ ইমনের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়, তেমনি হিন্দি চলচ্চিত্র সংগীতেও এর ব্যবহার কম নয়। রাগ ইমন একটি পূর্ণাঙ্গ (সম্পূর্ণ বা সপ্তস্বরী) রাগ, যা কল্যাণ ঠাটের অন্তর্ভুক্ত।

এই রাগটি হিন্দুস্তানী এবং কর্ণাটকী, দুই ধারার উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতেই সমানভাবে গাওয়া হয়। একটি মত অনুযায়ী, ইমন রাগ আদিকাল থেকেই দক্ষিণ ভারতে প্রচলিত ছিল, যেখানে এটি রাগ কল্যাণ নামে পরিচিত। ফলে সময়ের প্রবাহেও রাগটি তার মূল রূপ বিশেষ পরিবর্তন ছাড়াই টিকে রয়েছে। অন্য এক মত বলছে, ইমন আসলে ইয়েমেনের জনপ্রিয় সুরের রূপান্তর, যা মুসলিম শাসনামলে পশ্চিম এশিয়া বা মধ্যপ্রাচ্য থেকে ভারতে আসে এবং শাস্ত্রীয় সংগীতে প্রবেশ ঘটান কিংবদন্তি সংগীতজ্ঞ আমীর খসরু

ইমনের প্রকৃতি

রাগ ইমনের মূড যেন এক শিশিরভেজা সন্ধ্যার ছবি আঁকে — নরম, আর্দ্র, আবেগময় ও মায়াময়। এই রাগের সংগীত যেন জোনাকির আলোয় রাঙানো বিষণ্ণ সন্ধ্যার কথা মনে করিয়ে দেয়। ইমন মূলত ভক্তিরসে সিক্ত প্রেমের রাগ — প্রেমের উত্থান কিংবা প্রেমের বিচ্ছেদের আবহ দুই ক্ষেত্রেই ইমন আপন মহিমায় জেগে ওঠে।

প্রেম, বিরহ, আরাধনা, প্রাপ্তি বা অপ্রাপ্তির আবেগ প্রকাশে মেধাবী সুরকাররা যখনই ইমনের কাছে ফিরে গেছেন, তখনই রাগটি ভিন্ন ভিন্ন রূপে ধরা দিয়েছে। ঠিক যেমন একে একে আবিষ্কৃত হয় একেকটি মণিমুক্তা।

ইমনের রূপান্তর: ইমন কল্যাণ

রাগ ইমনের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো এর “মা” (মধ্যম) স্বর। এই “মা” যদি সামান্য পরিবর্তিত হয়, তবেই জন্ম নেয় এক নতুন, আরও কোমল রাগ — ইমন কল্যাণ। ইমনের যেখানে তীব্র মা ব্যবহৃত হয়, সেখানে ইমন কল্যাণে ব্যবহৃত হয় শুদ্ধ মা। এই সামান্য রূপান্তর সংগীতের আবহে বিশাল পরিবর্তন নিয়ে আসে। তবে মা-র পরিবর্তন ছাড়া, ইমন ও ইমন কল্যাণের আরোহ, অবরোহ এবং চলন প্রায় অভিন্ন থাকে।

রাগ ইমনের সাথে মেরু বেহাগ রাগেরও কিছু সাদৃশ্য রয়েছে, যা আরও একবার ইমনের বহুরূপী সৌন্দর্যকেই প্রকাশ করে।

রাগ ইমন

রাগ ইমন এর বিবরণ:

রাগ ইমনের সময় রাত্রির প্রথম প্রহর। আরোহ- অবরোহনে রাগটি খুবই সরল ও সহজ। ফলে এ রাগটি গাইতে সুবিধা, রাগ ভ্রষ্ট হবার আশংকা নেই। ইমন, এই নামটি কোত্থেকে উৎপত্তি হল, এ নিয়ে নানা মুনির নানা মত। এক দল পন্ডিত বলেন, মুসলমানদের এ দেশে আসার পর এ রাগটির জন্ম হয়েছে। কেউ বলেন, আমীর খসরু (যিনি অনেক রাগ, বাদ্যযন্ত্র, তাল সৃষ্টি করেছিলেন) এই রাগটির তিনি জনক।

দক্ষিণী পন্ডিতরা বলেন- আমাদের ইমন কল্যান রাগের একটি প্রকার হল ইমন। আবার কেউ বলেন ইরান থেকে অথবা আরবের ইয়ামেন প্রদেশ থেকে এদেশে এর আবির্ভাব হয়েছে। আর একদল পণ্ডিত বলেন ‘ইহমন’ এর থেকেই ইমন শব্দটির জন্ম। এই নিয়ে তারা একটি গল্প শোনান, তারা বলেন এক দিন সন্ধ্যার পর বাবা হরিদাস গোস্বামী, মন্দিরে তার ইষ্টদেবের কাছে ধ্যানমগ্ন হয়ে গান করতে থাকেন, সেই গানের বাণী ছিল “ইহমন অরপণ কর তুমহারি”। তার শিষ্যগণ মুগ্ধ হয়ে এই সঙ্গীত শ্রবণ করেন। পরের দিন তার শিষ্যবাই আবার অনুরোধ করে বলেন ‘বাবা আপনি কালকে যে গানটি গেয়েছিলেন ‘ইমন’ এইটি আবার আজ আমাদের শোনান এবং আমাদের শেখান। তারপর থেকেই নাকি ইমন রাগের নাম প্রচলন হল।

ইমন রাগ ভক্তি রসাশ্রিত। ভজনা, উপাসনা, প্রার্থণা, প্রশস্তি ইত্যাদিতে ধ্রুপদ ধামার থেকে অর্থাৎ পুরনো আমল থেকেই আজকের রবীন্দ্রসংগীত পর্যন্ত এই রাগটিকে ব্যবহার করা হয়েছে। আবার এই ভক্তিরসের ভেতরেই কিছু করুণ, কিছু বীর রসের আবির্ভাব ঘটিয়ে রাগটিকে আরো শ্রুতিমধুর করে তোলা হয়েছে। রাগটি তাই সহজেই মানুষের হৃদয় ছুয়েঁ যায়। বিশেষত যারা কোমল হৃদয়ের তাদের কাছে এই রাগটি অধিকতর আবেদন নিয়ে প্রতিভাত হয়। হিন্দী সিনেমায় রোমান্টিক গানগুলোতে এই রাগের বহুল ব্যবহারের কারণ হচ্ছে- এই রাগ প্রেমের অনুভূতিকে খুব ভাল করে প্রকাশ করে। ভারতবর্ষে পুজা ও প্রেম দুটো আবেগকে এই প্রকৃতির বিবেচনা করা হয়। তাইতো রবীন্দ্রনাথ পুজা ও প্রেমকে একই প্রকৃতির মধ্যে রেখেছেন।

ঠাট- কল্যাণ
স্বর- তীব্র মধ্যম
জাতি- সম্পূর্ণ
বাদী-গান্ধার
সমবাদী- নিষাদ
সময়- রাত্রি প্রথম প্রহর
পূর্বাঙ্গ প্রধান রাগ
প্রকৃতি- শান্ত ও গম্ভীর
শ্রেণী- শালগ
ন্যাস স্বর- ষড়জ, গান্ধার, পঞ্চম, নিষাদ

আরোহন- ন্ র গ, হ্ম ধ ন, র্স
অবরোহন- র্স ন, ধ প হ্ম গ, র স
পকড়, স্বরূপ – স, ন্ র র গ, র গ র হ্ম গ, গ হ্ম প, প হ্ম ধ প হ্ম প, হ্ম গ হ্ম ধ ন ন র্স, র্স ন ন ধ প, প হ্ম ধ প হ্ম গ, র গ হ্ম প র গ, র গ র ন র স

 

রাগ ইমনের বিস্তার-

ন্‌র ন্‌ধ্‌ হ্ম্‌ধ্‌ন্‌রস, ধ্‌ন্‌রগ গরহ্মগ হ্মপ পহ্মগরস, ন্‌স ন্‌রগ গহ্মগপ গপরগহ্মপ, হ্মগহ্মধন নধননর্স (অন্তরা)…..
নর্রনধন হ্মধন হ্মধননর্স, নর্র নধনর্স র্সনধনর্স র্রর্স, নর্রর্গ র্গর্রর্হ্মর্গ র্হ্মর্গর্গর্রর্স,

 

রাগ ইমনের তান-

১. ন্‌রা গরা গহ্মা গহ্মা / গপা হ্মপা গহ্মা গরা / সা

২. রগা রসাঃ গঃ রসা / ন্‌রা হ্মগা রসা ন্‌রা / সা

৩. গরা গহ্মা ধনা ধহ্মা / ধনা র্সনা ধপা হ্মগা / রসা

৪. হ্মধা নধা হ্মধা হ্মগা / গহ্মা গরাঃ গঃ রসা /

৫. সনা্ ধ্‌না্ রগা ॥ সনা্ ধ্‌না্ রগা সনা্ / ধ্‌না্ রগা গরা সনা্ / সা

৬. পহ্মা পধা হ্মধা পহ্মা / নর্সা ধনা র্সনা র্রর্সা /

৭. গগা রগা হ্মহ্মা গহ্মা / ধধা হ্মধা ননা ধনা / র্সনা র্সধা নর্সা নধা / নধা নহ্মা ধনা ধহ্মা ॥ গহ্মা ধনা ধহ্মা গহ্মা /
ধনা র্সা গহ্মা ধনা / ধহ্মা গহ্মা ধনা র্সা / গহ্মা ধনা ধহ্মা গহ্মা ॥ ধনা র্সা নর্রা র্সনা / ধহ্মা গহ্মা ধনা র্সনা / র্সা

৮. ন্‌রা গহ্মা পহ্মা গরা / রগা হ্মধা নধা হ্মগা / গহ্মা ধনা র্সনা ধহ্মা / র্সনা ধহ্মা গহ্মা ধনা ॥ র্সনা ননা ধনা ধহ্মা /
নধা ধধা হ্মধা হ্মগা / ধহ্মা হ্মহ্মা গহ্মা গরা / গহ্মা পহ্মা গহ্মা গপা ॥ হ্মপা গহ্মা গপা হ্মগা / হ্মগা রহ্মা গরা হ্মগা / রসা

৯. ন্‌রা গহ্মা পহ্মা গহ্মা / গরা রগা হ্মধা নধা / হ্মধা হ্মগা গহ্মা ধনা / র্সনা ধনা ধহ্মা হ্মধা ॥ নর্রা র্গর্রা নর্রা র্সনা
ধনা র্সধা নর্সা নধা / হ্মধা নহ্মা ধনা ধহ্মা / গহ্মা পগা হ্মপা হ্মগা ॥ রগা হ্মরা গহ্মা গরা / ন্‌ধা্ ন্‌রা গহ্মা পধা /
পহ্মা গরা সা পহ্মা / গরা সা পহ্মা গরা ॥ সা ন্‌রা গহ্মা পধা / পহ্মা গরা সা পহ্মা / গরা সা পহ্মা গরা /
সা ন্‌রা গহ্মা পধা ॥ পহ্মা গরা সা পহ্মা / গরা সা পহ্মা গরা / সা

১০. ন্‌রা ন্‌রা গরা গরা / রগা রগা হ্মগা হ্মগা / গহ্মা গহ্মা ধহ্মা ধহ্মা / হ্মধা হ্মধা নধা নধা ॥ নর্রা র্রর্রা নর্রা র্রর্রা /
র্গর্রা ধনা ননা ধনা / ননা র্সনা হ্মধা ধধা / হ্মধা ধধা নধা গহ্মা ॥ হ্মহ্মা গহ্মা হ্মহ্মা ধহ্মা / গরা সনা্ রসা গরা / সা

১১. গহ্মা ধনা র্রর্গা ॥ র্রর্সা নর্রা র্সনা ধহ্মা / গরা সর্গা র্রর্সা নর্রা / র্সা

১২. হ্মধা নধা হ্মধা ধহ্মা / ননা ধনা ধহ্মা গহ্মা / ধহ্মা গহ্মা হ্মগা ধধা / হ্মধা হ্মগা নর্রা র্গর্রা ॥ নর্রা র্রর্গা র্রর্রা র্রর্গা /
র্রর্সা ধনা র্সনা ধনা / নর্সা ননা নর্সা নধা / ধনা র্সনা ধহ্মা গহ্মা ॥ ধগা হ্মনা গহ্মা র্সা / গহ্মা ধগা হ্মনা গহ্মা / র্সা

১৩. গহ্মা ধনা র্সনা / ধনা ধর্সা নর্সা ধনা ॥ ধর্সা নর্সা ধনা ননা / ধর্সা র্সর্সা নর্সা র্সর্সা / ধনা ধর্সা নর্সা ধনা /
ধর্সা নর্সা র্সনা ধনা ॥ ধহ্মা ধহ্মা গরা গহ্মা / র্সা র্সা র্সা র্সনা / ধনা ধহ্মা ধহ্মা গরা / গহ্মা র্সা র্সা র্সা ॥
র্সনা ধনা ধহ্মা ধহ্মা / গরা গহ্মা র্সা র্সা/ র্সা

১৪. র্সনা ধনা র্সনা / ধনা ধনা ধর্সা নর্সা / ধনা র্সা ধনা ধর্সা ॥ নর্সা ধনা র্রা ধনা / ধর্সা নর্সা ধনা র্গা /
ধনা ধর্সা নর্সা ধনা / র্হ্মা র্গর্রা র্সর্গা র্রর্সা ॥ নর্রা র্সনা ধহ্মা গরা / সর্গা র্রর্সা নর্রা র্সর্গা / র্রর্সা

১৫. হ্মধা নধা ॥ নর্সা ধনা র্সনা ধহ্মা / গহ্মা ধনা র্সা হ্মধা / নধা নর্সা ধনা র্সনা / ধহ্মা গহ্মা ধনা র্সা ॥
হ্মধা নধা নর্সা ধনা / র্সনা ধহ্মা গহ্মা ধনা / র্সা

 

ইমন রাগ নিয়ে একটি গান:

[ইমন রাগের গান
গাইতে ভালো লাগে সন্ধ্যায়]-২
কড়িমার ছোঁয়ায় মন
বন্দি হতে চায় সে সুর কারায়
ইমন রাগের গান
গাইতে ভালো লাগে সন্ধ্যায়।

[ইমন এমন যেমন আনন্দ বেদনার মিলন]-২
[গানের সুরে যেন কান্না ঝুরে]-২
সে কান্না কাঁদতে চায় মন চায়
ইমন রাগের গান
গাইতে ভালো লাগে সন্ধ্যায়।

[ইমন দিনের অন্তিম আলাপন
কড়িমার ছোঁয়ায় দিন আবার নূতন]-২
[ইমন জানে তারে চেনে যারা বেদন মনে]-২
[রিক্ত প্রাণের আশ্রয় ইমনই]-২
সে মন ইমন সনে বার বার যায়
ইমন রাগের গান
গাইতে ভালো লাগে সন্ধ্যায়
কড়িমার ছোঁয়ায় মন
বন্দি হতে চায় সে সুর কারায়
ইমন রাগের গান
গাইতে ভালো লাগে সন্ধ্যায়।

 

ইমন রাগে ছায়াছবির গান:

  • Jab deep jale ana

 

ইমন রাগে আধুনিক গান:

  • আজ এই বৃষ্টির কান্না দেখে

ইমন রাগে রবীন্দ্রনাথের গান রবীন্দ্র সঙ্গীত:

  • এ মোহ আবরণ
  • এ মণিহার আমায়’
  • এই উদাসী হাওয়ার পথে পথে
  • দাঁড়িয়ে আছো তুমি

 

ইমন রাগে নজরুলের গান বা নজরুল সঙ্গীত:

নজরুল গীতিতে সম্পূর্ণ ইমন রাগে গান নেই বলা যায়।  রাগ ইমন তার পছন্দের রাগ ছিল- তাই রাগ ইমন তার গানে এসেছে মিশ্র রুপে। তিনি রাগ ইমনের সাথে অন্যান্য রাগ মিশিয়ে তৈরী করেছেন কিছু গান।

  • ছন্দের বন্যা হরিণী অরণ্যা [ রাগ ইমন | মিশ্র তালঃ কাহার্‌বা ]
  • স্নিগ্ধ শ্যাম কল্যাণ রূপে রয়েছ [ রাগঃ শ্যামকল্যাণ / ইমন কল্যাণ তালঃ একতাল ]
  • আমি দ্বার খুলে আর রাখব না [ রাগ ইমন | তালঃ দাদ্‌রা ]
  • এসো বঁধূ ফিরে এসো [ রাগ ইমন মিশ্র | তালঃ দাদ্‌রা ]
  • বসিয়া বিজনে কেন একা মনে [ রাগ ইমন মিশ্র | তালঃ কাহার্‌বা ]
  • যবে তুলসী তলায় প্রিয় সন্ধ্যা [ রাগ ইমন মিশ্র | সুরঃ কমল দাসগুপ্ত ]

 

ইমন রাগে গজল:

  • Ranjish hi sahi, dil hi dukhane ke liye aa – MH
  • Shola hun bhadakne ki gujarish nahin karta – JS
  • Tum nahin, gam nahin, sharab nahin ‘ JS
  • Jal bhi chuke parvane MH

 

আরও দেখুন:

Leave a Comment