ভাবোদ্দীপনায় সংগীতের মতো শক্তিশালী বোধ হয় আর কিছুই নেই। সুগায়কের কণ্ঠে নানাবিধ ভাবোদ্দীপক সংগীত সাধারণের অস্তরে যেমন প্রভাব বিস্তার করতে পারে তেমন বোধ করি আর কিছুই পারে না। ভারতীয় সংগীতের ইতিহাসে সংগীতের মোহিনীশক্তি সম্পর্কে শত শত কাহিনী প্রচলিত আছে। প্রাণীমাত্রের চিত্তবিনোদন তো বটেই এমন কি জড়পদার্থকেও যে সংগীত প্রভাবিত করতে পারে এমন কাহিনীও প্রচলিত আছে।
ভাবোদ্দীপনায় সংগীত
গ্রীসীয় পুরাণে আছে যে, সুকণ্ঠী গায়ক অর্ফিয়ুস তার প্রেয়সী ইউবিডাইসকে সংগীতের প্রভাবেই নাকি মৃত্যুরাঞ্জের কাছ থেকে উদ্ধার করেছিলেন।
আধুনিককালের সুরুতে এ দেশে এমন এক সময় ছিল যখন সংগীতব্যিাকে অনেকে ভাল চোখে দেখতেন না। সেই ভ্রান্ত ধারণা এবং কুসংস্কার সর্বপ্রথম দূর করার চেষ্ট। করেন এবং কৃতকার্য হন বাংলার গৌরব এবং সর্বপ্রথম বিদেশ থেকে সংগীতের সর্বোচ্চ সম্মান ডকটর অব মিউজিক (D. Mus) প্রাপ্ত, রাজা সৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর। ইনি সর্বপ্রথম গেকোয়ারের মহারাজার সহযোগিতায় ‘ভারত সংগীত সম্মিলনী’র উত্থোগে সংগীত প্রচারের ব্যবস্থা করেন। ফলস্বরূপ বর্তমানে দেশের বিদ্যালয়গুলিতেও সংগীত ও ললিতকলা শিক্ষার ব্যবস্থা হয়েছে। তবে দুঃখের বিষয় এখনও অনেকের ধারণা সংগীত সাধনা অন্যান্য বিদ্যাশিক্ষায় মনোনিবেশের অন্তরায়।
এই প্রসঙ্গে জার্মানীর একজন প্রসিদ্ধ বৈজ্ঞানিকের উক্তি উল্লেখযোগ্য :
“Music far from a destruction in studies, would, as Doctors and Scientists have definitily proved, impart a soothing and questioning influence on the nerve centres and as such increase the working capacity of a brain worker”
দৃষ্টান্তেরও অভাব নেই, যেমন জগদ্বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক এ্যালবার্ট আইনস্টাইন এবং পোল্যাণ্ডের ভূতপূর্ব মন্ত্রী পেডারওয়েস্কি বিখ্যাত বেহালাবাদক ছিলেন। বিখ্যাত সমালোচক ও ঔপন্যাসিক রোমারোলা পাকা পিয়ানো বাদক ছিলেন রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, বিবেকানন্দ এবং বহু রাজা মহারাজাদের নামও এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য।
অতএব মন ও মস্তিষ্ক সতেজ ও সক্রিয় রাখার জন্য সংগীত ও ললিতকলা শ্রেষ্ঠ উপাদান হিসাবে স্বীকৃত। কারণ সংগীতচর্চা মনের একাগ্রতা বৃদ্ধি করার শ্রেষ্ঠতম উপায়, এবং মনের একাগ্রতা যে সর্ব কার্যে অপরিহার্য সে কথা বলাই বাহুল্য।
সংগীতের উৎপত্তি :
ন নাদেন বিনা জ্ঞানং ন নাদেন বিনা শিবম্ ।
নাদরূপং পর: জ্যোতির্ণাদরূপী স্বয়ং হরিঃ ॥

অনাদ বিন জ্ঞান অসম্ভব, নাদ বিন। মঙ্গল অসম্ভব, পরজ্যোতিঃ নাদরূপ এবং স্বয়ং হরিও নাদরূপী বিষ্ণুপুরাণে আছে, সকল গীতিকা শব্দযুর্তিধর বিষ্ণুর অংশ। আমাদের দর্শনশাস্ত্রেও নাদকে ব্রহ্ম অর্থাৎ জগতের আত্মা বলা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে জগৎ সংগীতময়। কারণ নদীর কল্লোলে, বনের মর্মরে, পশুপক্ষীর কলকাকলিতে সংগীত নিরন্তর প্রবাহিত। অর্থাৎ পৃথিবীর সব-কিছুর মধ্যেই সংগীত অনাদিকাল ধরে ঝংকৃত হয়ে চলেছে। মানবজাতি তার নৈসর্গিক শক্তির প্রভাবে ভাব, ভাষা, বিবিধ চিন্তা ও কামনা ব্যক্ত করে সংগীতের পরমোৎকর্ষ সাধন করেছে। কারণ মানুষ মাত্রেরই কমবেশি সংগীত-শক্তি আছে।
সংগীতের ক্রমবিকাশ পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে ধনী, দরিদ্র, সন্ন্যাসী, গৃহবাসী, সাহিত্যিক, বৈজ্ঞানিক প্রভৃতি সকলেই বিচিত্র এবং অভিনব সৃষ্টির সাহায্যে সংগীতের উন্নতিসাধন ও নানাভাবে আলোকপাত করেছেন। কিন্তু কথা আগে না হ্রর আগে এ নিয়ে যথেষ্ট মতভেদ আছে। অর্থাৎ সংগীতের উৎপত্তি সম্বন্ধে নানারকম অভিমত প্রচলিত আছে। দেশবিদেশের মনীষীগণ এ সম্পর্কে যেসকল দার্শনিক, ধর্মভাবাপন্ন বা কাল্পনিক অভিমত প্রকাশ করেছেন, তার কয়েকটির এখানে উল্লেখ করা হোল ।
হিন্দুশাস্ত্রানুসারে কথিত আছে যে, বেদ চতুষ্টয়ের স্রষ্টা ব্রহ্মা সংগীতবিদ্যা সৃষ্টি করে শিবকে এবং শিব সরস্বতীকে দান করেছিলেন। তাই বীণা পুস্তক ধারিণী সরস্বতীকে এর অধিষ্ঠাত্রী দেবীরূপে বন্দনা করা হয়। ক্রমে স্বর্গের দেবর্ষি নারদ ও অপ্সরা-কিন্নরীগণ সংগীতবিদ্যা লাভ করেন। পরবর্তীকালে ভূলোকের ভরত, রাবণ, হনুমান প্রভৃতি কঠোর সাধনায় সংগীতবিদ্যা লাভ করেন।
আরবে প্রচলিত একটি প্রবাদে কথিত আছে যে, হজরত মুসা পাহাড়ে ভ্রমণকালে একদিন একটি দৈববাণী শুনতে পান যে, “হে ধূসা তোমার ‘অসা’ (ফকীরদের কাছে থাকে, একপ্রকার অস্ত্র) দিয়ে সামনের পাথরে আঘাত করে।”, সেই নির্দেশানুসারে পাথরে আঘাত করলে তা সাত খণ্ডে খণ্ডিত হয়ে যায় এবং সেগুলি থেকে সাতটি জলধারা প্রবাহিত হতে থাকে। সেই সাতটি জলধারা থেকেই নাকি সপ্তস্থরের উৎপত্তি।
আরবের আর একটি প্রবাদে কথিত আছে যে, ‘মুসিকার নামে নম্বানাকে সাতটি ছিদ্রযুক্ত একপ্রকার পাখি ছিল যার ধ্বনিসমূহ থেকেই নাকি সপ্তস্থরের উৎপত্তি।
জেমস্ লঙ্, বলেছেন যে, শিশুর হাসিকান্না প্রভৃতি স্বাভাবিক মনস্তত্ত্ব থেকেই মানুষ সংগীত পেয়েছে। চার্লস ডারুইন বলেছেন, পশুপক্ষীর ধ্বনি থেকেই সংগীতের উৎপত্তি। প্রসিদ্ধ বৈজ্ঞানিক আইনস্টাইনও এই অভিমত সমর্থন করেছেন।
ফ্রয়েড, হার্ডার, রুশো, হার্বার্ট স্পেন্সর প্রমুখ পাশ্চাত্য মনীষীদের মতে মানুষ হৃদয়াবেগ অনুসারে কথোপকথনে নিজের অজ্ঞাতেই কিছু-কিছু স্থর প্রয়োগ করে থাকে, যার উৎকর্ষসাধনে সংগীতের উৎপত্তি।
পণ্ডিত J. Kunst তার Ethnomusicology গ্রন্থে বলেছেন:
“Competition in courting; imitation of bird calls; rhythms demanded by working procedures; the lulling of an infant, the release of passion; patterns of speach, on more speci fically, a primeval tonal communication that gave rise to both language and music; and calling from a distance, which requires an essentially musical treatment in order that the voice may carry.”- Encyclopaedia Britannica, (1971), (Vol. 15, p. 1077).
স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ বলেছেন যে, আদিম যুগে সংগীত ছিল মানুষের অন্তরে লুকানো। নানা কাজের মাঝে মানুষ নিজের চেয়ে শক্তিমান প্রকৃতিকে বুঝতো। বিভিন্ন পশুপক্ষীর ধ্বনিকে তারা মঙ্গলামঙ্গলের প্রতীক মনে করতো। অনুকরণপ্রিয় মানুষ সেই ধ্বনির সাহায্যে নিরর্থক ভাষার সংগীতে বন্দনা করতো বিশ্বদেবতার। সেই সংগীতে গোড়ার দিকে সম্ভবত: একটি কি দুটি মাত্র স্বরের ব্যবহার ছিল। ক্রমে সপ্ত স্থরের বিকাশ হয়। – স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ : ভারতীয় সংগীতের ইতিহাস (১৯৬১)।
আরও পড়ুন:
2 thoughts on “ভাবোদ্দীপনায় সংগীত”