আবু নছর মোহাম্মদ গাজীউল হক হলেন একজন বাংলাদেশী সাহিত্যিক, গীতিকার এবং ভাষাসৈনিক। যিনি ১৯৫২ সালের বাংলা ভাষা আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। তিনি গাজীউল হক নামেই সমধিক পরিচিত। ভাষা আন্দোলনসহ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, কাজী মোতাহার হোসেনসহ বিখ্যাত ব্যক্তিদের সংস্পর্শে এসে গাজীউল হক বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলনে অংশ নেন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন সরকার ১৪৪ ধারা জারি ভঙ্গকারীদের অন্যতম ছিলেন গাজীউল হক।
গাজীউল হকের ‘ভুলব না ভুলব না ভুলব না এই একুশে ফেব্রুয়ারি ভুলব না’ গানটি গেয়ে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত প্রভাতফেরি করা হতো। তিনি রাষ্ট্রভাষা পদক ও সম্মাননা স্মারক, শেরেবাংলা জাতীয় পুরস্কার লাভ করেন।আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যও ছিলেন তিনি। এছাড়া গাজীউল হক প্রেস ইন্সটিটিউট অব বাংলাদেশ (পিআইবি) এর চেয়ারম্যান ছিলেন।
Table of Contents
প্রাথমিক ও ছাত্র জীবন
গাজীউল হক ১৯২৯ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া থানার নিচিন্তা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন৷ গাজীউল হকের বাবা মওলানা সিরাজুল হক ছিলেন কংগ্রেস ও খেলাফত আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী এবং মা নূরজাহান বেগম । একটি মক্তবে তিনি প্রথমে পড়াশুনা শুরু করেন এবং পরে তিনি কাশিপুর স্কুলে ভর্তি হন। এই স্কুল থেকে তিনি উচ্চ প্রাইমারি বৃত্তি লাভ করেন। ১৯৪১ সালে তিনি বগুড়া জেলা স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হন।
এই স্কুলে পড়ার সময়েই তিনি শিক্ষক সুরেন বাবুর সান্নিধ্যে এসে দেশপ্রেমিক হয়ে ওঠেন। ১৯৪৬ সালে এই স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। ১৯৪৮ সালে গাজীউল হক বগুড়া কলেজ থেকে আইএ পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিষয়ে অর্নাস ভর্তি হন।
এরপর ১৯৫১ সালে বিএ অর্নাস পাশ করে আজিজুল হক কলেজে এমএ ভর্তি হন। এসময় তিনি ফজলুল হক হলের আবাসিক ছাত্র হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের উপস্থিত বক্তৃতা, আবৃত্তি, বির্তক প্রভৃতি প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে খ্যাতি অর্জন করেন। ১৯৫২ সালে তিনি এমএ পাশ করেন। কিন্তু ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দানের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ তার এমএ ডিগ্রি কেড়ে নেয়। পরবতীতে ছাত্রনেতা ইশতিয়াক, মোহাম্মদ সুলতান, জিল্লুর রহমান প্রমুখের প্রচণ্ড আন্দোলনের চাপে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তার এমএ ডিগ্রি ফেরত দিতে বাধ্য হয়। ১৯৫৩ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন শাস্ত্রে ভর্তি হন। ১৯৫৬ সালে তিনি একসঙ্গে ১১ পেপার আইন পরীক্ষা দেন।
রাজনৈতিক জীবন
আজিজুল হক কলেজে ভর্তি হয়েই তিনি অধ্যক্ষ ভাষা বিজ্ঞানী মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সংস্পর্শে এসে রাজনীতিতে আসেন। ১৯৪৪ সালে তিনি বঙ্গীয় মুসলিম ছাত্রলীগ বগুড়া জেলা শাখার যুগ্ম সম্পাদক নিযুক্ত হন।[২] ১৯৪৬ সালে তিনি ধুবড়িতে অনুষ্ঠিত আসাম মুসলিম লীগ কনফারেন্সে যোগ দিতে গিয়ে মাওলানা ভাসানীর ব্যক্তিত্ব, বাগ্মীতা এবং নেতৃত্বে আকৃষ্ট হন। ১৯৪৭ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুব লীগের ঈশ্বরদী কনফারেন্সে উত্তরবঙ্গ শাখার যুগ্ম-সম্পাদক নির্বাচিত হন। ওই বছর ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর ঢাকায় গণতান্ত্রিক যুবলীগের দুদিনব্যাপী কর্মী সম্মেলনের গাজীউল হক বগুড়ার পাঠচক্র ‘শিল্পায়নে’র সদস্যদের সঙ্গে অংশ নেন।
১৯৪৮ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের বগুড়া শাখার সভাপতি নির্বাচিত হন। এ সময় থেকেই রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবির সংগ্রাম শুরু হয়। ১১ মার্চ গাজীউল হক বগুড়া কলেজ থেকে ছাত্রদের মিছিল নিয়ে বগুড়া শহর প্রদক্ষিণ করেন। বগুড়া জিলা স্কুল ময়দানে সেদিনের সভার সভাপতি ছিলেন মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। সভাপতি হিসেবে বাংলাকে রাষ্ট্র্রভাষা করার দাবির স্বপক্ষে দীর্ঘ সময়ব্যাপী যুক্তি ও তথ্য নির্ভর ভাষণ দেন।
এসময় তিনি লেখাপড়ার পাশাপাশি ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন ও বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে কারাবরণ করেন। ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্ন-বেতন কর্মচারীগণ ধর্মঘট আহবান করলে ছাত্রনেতাদের সঙ্গে তিনিও এর সমর্থন করেন। ১৯৪৯ সালের দুর্ভিক্ষ মোকাবেলায় তিনি কাজ করেন। এ সময় মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে একটি ভুখা মিছিল বের হয়। এই মিছিলে গাজীউল হকও শরিক হন।
কর্মজীবন
১৯৫৭ সালে আইনজ্ঞ সৈয়দ নওয়াব আলীর অধীনে বগুড়া বারে যোগদানের মধ্য দিয়ে তার কর্মজীবন শুরু হয়। ৬২’র শিক্ষা আন্দোলনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৬৩ সালের মার্চ মাসে পূব-পাকিস্তান ঢাকা হাই কোর্টে আইন ব্যবসায়ের সনদ লাভ করেন। ১৯৭২ সালে তিনি বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টে যোগদান দেন। সর্বোচ্চ আদালতে একজন দক্ষ আইনজীবী হিসেবে তিনি পরিচিতি লাভ করেন।
রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের বাইরে গাজীউল হক তার সৃজনশীলতারও পরিচয় দিয়েছেন। তার রচিত গ্রন্থের সংখ্যা ৯টি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের ওপর প্রথম বই লিখেন গাজীউল হক। তার বইয়ের নাম ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। এ ছাড়া উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষা প্রচলনের জন্য গাজীউল হক ছিলেন আপোষহীন। এই নিয়ে তিনি তার সংগ্রামের কথা বলেছেন ‘উচ্চ আদালতে বাংলা প্রচলন’ বইটিতে।
সম্মাননা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৪তম সমাবর্তনে গাজীউল হক-সহ আরেক ভাষাসৈনিক আব্দুল মতিনকে সম্মানসূচক ডক্টর অব লজ ডিগ্রি দেওয়া হয়। ২০০০ সালে তিনি একুশে পদক পুরস্কারে ভূষিত হন। ২০০১ সালে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির পক্ষ থেকে ‘জাহানারা ইমাম পদক’ পান তিনি। ২০০৪ সালে পান ‘শের-ই-বাংলা জাতীয় পুরস্কার’৷ ছিলেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যও। এ ছাড়া গাজীউল হক প্রেস ইন্সটিটিউট অব বাংলাদেশ (পিআইবি) এর চেয়ারম্যান ছিলেন।
মৃত্যুবরণ
২০০৯ সালের ১৭ জুন বিকালে ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তার বয়স হয়েছিল ৮০ বছর। ঐদিন সকালে ঘুমের মধ্যে তিনি স্ট্রোকে আক্রান্ত হন। গুরুতর অবস্থায় স্কয়ার হাসপাতালে নেয়া হলে লাইফ সমর্থনের মাধ্যমে তাকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা চালানো হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পরলোকগত হন তিনি।
আরও দেখুনঃ