খেয়াল বা খেয়াল গান – সঙ্গীত শৈলী [ Kheyal, Music Genre ]

খেয়াল বা খেয়াল গান – সঙ্গীত শৈলী [ Kheyal, Music Genre ] নিয়ে আজকের আলোচনা। ফারসি ভাষা ‘খ্যাল’ থেকে উদ্ভূত খেয়াল [ Kheyal ] শব্দের অর্থ হচ্ছে বিচার বা কল্পনা। সাংগীতিক পরিভাষায় খেয়াল হচ্ছে একধরনের শাস্ত্রীয় সংগীত যাকে উচ্চাঙ্গ বা রাগসংগীতও বলা হয়ে থাকে। নানাবিধ তান, বোলতান, আলাপ, বিস্তার, গায়কি, বো-বাঁট, সারগাম, তেহাই ইত্যাদি সহযোগে বিভিন্ন তালে আকর্ষণীয় ও উপভোগ্য করে রাগ গাওয়া হলে তাকে বলে খ্যয়াল বা খেয়াল। এর উৎপত্তি সম্পর্কে নানাবিধ মতবাদ প্রচলিত থাকলেও মূলত কাওয়ালি গান থেকেই খেয়াল গানের সৃষ্টি হয়েছে।

 

খেয়াল বা খেয়াল গান - কী?

 

মুসলিম রাজত্বকালে পাঠান বংশোদ্ভূত দিল্লির সম্রাট আলাউদ্দিন খিলজির (১২৯৬-১৩১৬) রাজদরবারের উচ্চ পর্যায়ের সভাসদ ছিলেন সংগীতজ্ঞ হজরত আমির খসরু ওরফে আবুল হাসান। তিনি নিজ আবিষ্কৃত কাওয়ালি গানের সংস্কার করেন। অতঃপর নানাবিধ গবেষণা, সংযোজন, বিয়োজন, পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের মাধ্যমে সংস্কারকৃত সেই কাওয়ালি গানে একটি প্রথাসিদ্ধ রূপদানের মাধ্যমে খেয়াল গানের উদ্ভব করেন।

এই গানের বিষয়বস্তু প্রধানত শৃঙ্গার রসাত্মক হলেও গানে ভক্তিরসের প্রাধান্যও পরিলক্ষিত হয় এবং সংগীতের শিল্প সৌন্দর্যের মাধ্যমে এর প্রকাশ ঘটে। হিন্দি, উর্দু পাঞ্জাবি এই তিন ভাষায় খেয়াল গান রচিত হলেও অনেক সময় একই গানে হিন্দি উর্দু উভয় ভাষারই সংমিশ্রণ লক্ষ করা যায়। গাম্ভীর্য কম বলে খেয়াল গানের সঙ্গে তবলা-বাঁয়া সংগত করা হয়ে থাকে।

এই গানে একতাল, ত্রিতাল, আড়া চৌতাল, ঝুমরা ইত্যাদি তালের ব্যবহার বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়। খেয়াল গান দুই প্রকারের হয়ে থাকে, যথা – দ্রুত বা ছোট খেয়াল এবং বিলম্বিত বা বড় খেয়াল।

Table of Contents

খেয়াল বা খেয়াল গান – সঙ্গীত শৈলী [ Kheyal, Music Genre ]

 

পণ্ডিত ভীমসেন জোশী, ভীমসেন গুরুরাজ যোশী, ভারতীয় শাস্ত্রীয় কণ্ঠশিল্পী, কিরানা ঘরানা | Pandit Bhimsen Joshi, Bhimsen Gururaj Joshi, Indian Classical Vocalist, Kirana Gharana

 

 

দ্রুত বা ছোট খেয়াল :

খেয়াল গানের আবিষ্কারক হজরত আমির খসরু ওরফে আবুল হাসান কাওয়ালি গানের সংস্কার করে উপহার দেন দ্রুত বা ছোট খেয়াল এর দুটি বিভাগ যথাক্রমে স্থায়ী এবং অন্তরা। প্রতিটি বিভাগে দুটি বা তিনটি করে চরণ থাকে। ছোট খেয়াল চপল গতির বলে এর ভাষা সংক্ষিপ্ত হয়ে থাকে।

এ গানের বন্দিশ সাধারণত ত্রিতাল, ত্রিমাত্রিক একতাল ঝাঁপতালে বাঁধা হয়। ছোট খেয়ালে বিস্তার করার সুযোগ নেই। প্রথমে মধ্যলয়ে এবং তারপর দ্রুতলয়ে গেয়ে ছোট খেয়াল পরিবেশন করা হয়। রাগের শুদ্ধতা বজায় রেখে স্বাধীনভাবে শিল্পী গিটকিরি, কণ, তান, বোলতান, সরগম ইত্যাদি অলংকরণে দ্রুতলয়ে গেয়ে থাকেন। এই গানে শৃঙ্গার ছাড়া অন্য রসেরও প্রাধান্য ঘটে এবং কিছু হালকা রাগ ছাড়া প্রায় সব রাগেই দ্রুত বা ছোট খেয়াল শুনতে পাওয়া যায়।

 

ওস্তাদ আল্লাদিয়া খান

 

বিলম্বিত বা বড় খেয়াল :

বিলম্বিত বা বড় খেয়াল পঞ্চদশ শতাব্দীতে জৈনপুরের সুলতান হুসেন শাহ শর্কি কলাবন্ত খেয়াল প্রবর্তন করেন, যা বিলম্বিত বা বড় খেয়াল বলে সুপরিচিত। এই খেয়ালেরও স্থায়ী এবং অন্তরা নামে দুটি তুক বা বিভাগ বিদ্যমান। বিলম্বিত বা বড় খেয়ালের গতি-প্রকৃতি ধীরস্থির ও গম্ভীর হয়ে থাকে। এতে শৃঙ্গার রস ছাড়াও ভিন্ন প্রকৃতির আরো বহুবিধ রসের আবির্ভাব ঘটে।

বড় খেয়ালে বিলম্বিত লয়ে বিশেষ রীতিতে আলাপ করা হয়, যাকে বলে বিস্তার। গানের সঙ্গে আ-কার কিংবা গানের বাণী সহযোগে ধীর মন্থর গতিতে বিস্তার করা হয়। এর এবং ‘অন্তরা’ উভয় ভাগেই বিস্তার হবার পর চারগুণ ও আটগুণ লয়ে অধিকাংশ তান হয়। অবশ্য কোনো কোনো সময় বড় খেয়ালে অতিরিক্ত আরো দুটি বিভাগ ‘সঞ্চারী’ ও ‘আভোগ’ পরিলক্ষিত হলেও চারটি বিভাগের খেয়াল গানের সংখ্যা খুবই কম।

বড় খেয়ালের স্বরবিস্তারের প্রক্রিয়াটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ হওয়ায় গানের মাধ্যমে শিল্পী রাগের ভাবরূপসহ নিজ শিল্পীসত্তাকে প্রস্ফুটিত করে তোলেন। স্বরবিস্তারের শৈলীর মাধ্যমেই শিল্পী কোন ঘরানার অনুসারী তা সংগীতরসিক শ্রোতারা বুঝতে পারেন। এতে বিভিন্ন প্রকারের মিড়, গমক, তান, বোলতান ইত্যাদি অলংকরণ প্রয়োগ করা হয়ে থাকে।

গম্ভীর চলনের বিলম্বিত বা বড় খেয়ালে কণ বা স্পর্শস্বরের ব্যবহার গানের সৌন্দর্যকে আরো বেশি বৃদ্ধি করে। হালকা অঙ্গের রাগ ছাড়া অন্য সব রাগেই বড় খেয়াল গাওয়া হয়। এই গানে তবলা-বাঁয়া সহযোগে বিলম্বিত একতাল, আড়া চৌতাল, তিলোয়াড়া, ঝুমরা ইত্যাদি তালের সংগত প্রচলিত রয়েছে।

অষ্টাদশ শতাব্দীতে সর্বশেষ মুঘল সম্রাট মহম্মদ শাহ রঙ্গিলের রাজদরবারের অন্যতম সভারত্ন এবং তৎকালীন স্বনামখ্যাত খেয়ালগায়ক ও বীণাশিল্পী ওস্তাদ নিয়ামত খাঁ (সদারঙ্গ) অজস্র খেয়াল গান রচনা করেন। এতে বিভিন্ন প্রকারের মিড়, গমক, তান, বোলতান, কণসহ বিভিন্ন অলংকারাদি প্রয়োগ করে তিনি নতুন ও আকর্ষণীয় রূপে খেয়াল গানের প্রচলন করেন।

শিষ্যদের তিনি যে খেয়ালরীতি শিক্ষা দেন, পরবর্তীকালে শিষ্যপরম্পরায় তাই প্রচার এবং প্রসার লাভ করে। যথাযথ তালে ও সঠিক নিয়মানুযায়ী পরিবেশন করতে পারলে খেয়াল গান শ্রোতা-দর্শক হৃদয়ে অপূর্ব আনন্দের সঞ্চার করে। পিতার পথ অনুসরণ করে ওস্তাদ ফিরোজ খাঁ ওরফে অদারঙ্গ খেয়াল গানের উন্নতিতে অসামান্য অবদান রাখেন।

বর্তমানে বেশিরভাগ খেয়ালশিল্পী প্রথমে বিলম্বিত এবং পরে ছোট খেয়াল পরিবেশন করে থাকেন। খেয়াল গানের বিষয়বস্তু হিসেবে প্রেম, প্রকৃতি ও ভক্তি (ঈশ্বরের স্তুতি) এই তিনটি বিষয়ের প্রাধান্য রয়েছে। তবে বেশিরভাগ রচনাতেই প্রেমের প্রাবল্য অধিক পরিলক্ষিত হয়। তাই সংগীতজগতে খেয়াল অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং অধিক প্রচলিত একটি গীতধারা। শাস্ত্রীয় সংগীতের শাখাগুলোর মধ্যে খেয়াল গানই এখন সব থেকে এগিয়ে রয়েছে।

 

মগুবাই কুর্দিকার

 

খেয়াল গানের বৈশিষ্ট্য :

• আ-কার, ই-কার, উ-কার ইত্যাদি সহযোগে খেয়াল আরম্ভের পূর্বে তালছাড়া এবং আরম্ভের পরে তালযুক্ত আলাপ (এ সময় শিল্পীর স্বকীয়তা, বিচক্ষণতা ও সৃজনীশক্তির উদ্ভাবনী ক্ষমতার পরিচয় পাওয়া যায়। ফলে অধিক সময় আলাপ করলেও একঘেয়েমি লাগে না)।

• সরগম, বোলতান, তেহাই এবং তার পূর্বে গানের বাণী সহযোগে নতুনত্ব আনয়ন।

• রাগের ভাব ও রসের গভীরতা।

• ধ্রুপদ অপেক্ষা শব্দবিন্যাস কম।

 

সংগীতভুবনের সর্বকালের উজ্জ্বল নক্ষত্র ওস্তাদ নিয়ামত খা ওরফে সদারঙ্গ রচিত প্রচলিত একটি খেয়াল গান উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা হলো –

১৩                              +

এরি মেরি পিয়া নাহি আয়া

উনা বিনা মোরা জীয়া ঘাবড়ায়ে ॥

১৩

যা যারে কাগাতু যা সদারঙ্গ

পিয়াকো লায়ে বুলায়ে ॥

[ ঠাট : খাম্বাজ, রাগ দেশ, বাদীস্বর : প/র, সমবাদীস্বর : র/প, অঙ্গ: পূর্বাঙ্গ, জাতি : উড়ব-সম্পূর্ণ, গায়ন সময় রাত্রি দ্বিতীয় প্রহর, তাল: ত্রিতাল (১৬ মাত্রা), আরোহণ: স র ম প ন র্স, অবরোহণ: স ন ধ প ম গ র স।]

ওস্তাদ আমির খানের বেহাগের খেয়াল:

 

 

খেয়াল - কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়

 

 

কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় খেয়াল নিয়ে লিখেছেন:

যাঁরাই সুনীল গাভাসকরে’র ‘সানি ডেজ’ পড়েছেন তাঁরা এ গল্পের সঙ্গে পরিচিত। জীবনের প্রথম টেস্ট সিরিজে চারটি সেঞ্চুরি, তার মধ্যে আবার একটি ২২০ রানের ম্যারাথন ইনিংস, সাতশো চুয়াত্তর রান মাত্র চারটি টেস্ট ম্যাচে, একই ম্যাচে একটি, সেঞ্চুরি ও ডাবল সেঞ্চুরি করার কৃতিত্ব ক্রিকেট জগতে সাড়া ফেলে দিয়েছিল। আজহারউদ্দিনের ‘ডেবিউ’ সিরিজে পরপর তিনটি সেঞ্চুরির মতো, সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’র ট্রিলজির মে প্রথম দানেই মাৎ করে দিয়ে গাভাসকার ডাক পেলেন অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে রেস্ট অফ দা ওয়ার্লডের হয়ে খেলার। সঙ্গে যাবেন আরও দু’জন ভারতীয় খেলোয়াড় বিষণ সিং বেদি ও উইকেটকিপার ফারুক এঞ্জিনিয়ার। মেলবোর্ন এয়ারপোর্টে নিতে এসেছেন টিমের ক্যাপটেন গ্যারি সোবার্স, ইংল্যান্ডের টোনি গ্রেগ এবং সাউথ আফ্রিকার ওপনিং ব্যাটসম্যান হিলটন অ্যাকারম্যানদের। মোটরে যেতে যেতে সে গল্প শোনালেন টোনি গ্রেগ।

অ্যাকারম্যানের সঙ্গে একই ফ্লাইটে আসেন টোনি গ্রেগও সাউথ আফ্রিকা থেকে। অ্যাডিলেড এয়ারপোর্টে নেমে ওঁরা দেখেন সোবার্স এসেছেন, সঙ্গে একজন চশমা পরা প্রবীণ ভদ্রলোক পরনে ডার্ক স্যুট। গ্রেগ ও অ্যাকারম্যান দুজনই। লম্বা ফ্লাইটের পর ক্লান্ত, সোবার্স কী পরিচয় দিলেন কানে ঢোকেনি। মাল যতক্ষণ খালাস হচ্ছে, অ্যাকারম্যান তাঁর হাতের ওভারনাইট ব্যাগটি ওই প্রবীণ ভদ্রলোকের হাতে ধরিয়ে দিয়ে টয়লেটে গেলেন মুখ-হাত ধুতে। ফিরে এসে শিষ্টাচার করার উদ্দেশ্যে সেই ভদ্রলোকের হাত থেকে ব্যাগটি নিয়ে প্রশ্ন করলেন, অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটের সঙ্গে ওঁর কোনও সম্পর্ক আছে নাকি?

ভদ্রলোকের ঘাড় নাড়ায় এবার অ্যাকারম্যানের প্রশ্ন উনি ক্রিকেট খেলেছেন কি কখনও? জবাব এল ‘এই অল্পবিস্তর।’ এবার তৃতীয় প্রশ্ন ‘তাই নাকি, তা আপনার নামটা ঠিক জানতে পারলাম না, হোয়াট ডিড ইউ সে ইয়োর নেম ওয়াজ?’ সংক্ষিপ্ত জবাব ‘ডন ব্র্যাডম্যান। এর জোড়া গল্প দিতে পারি আমাদেরই কলকাতার সঙ্গীতের আড্ডা থেকে। আসর হচ্ছে আমার অগ্রজতুল্য সঙ্গীতজীবনের বহুদিনের সঙ্গী প্রদ্যুম্নকুমুদ মুখোপাধ্যায়ের বালিগঞ্জের বাড়িতে। বাঁশি বাজাচ্ছেন পান্নালাল ঘোষ, তবলায় তাঁরই ভাই নিখিল ঘোষ, জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের ছাত্র। চোখে চশমা, কালো দাড়ি, জ্ঞানবাবু এককালে দাড়ি রাখতেন, সম্ভবত তাঁরই অনুকরণে।

দিব্য আসর জমেছে, এমন সময়ে প্রদ্যুম্ন অর্থাৎ আমার পুতুদার বাবা ড. রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায়ের আবির্ভাব। নামকরা ঐতিহাসিক, লখনউ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর, তখন অবসর নিয়ে কলকাতাতেই থাকেন, তবে গানবাজনার সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক নেই, যদিও তাঁর পুত্র উস্তাদ আমীর খাঁর সাকরেদ এবং গানঅন্তপ্রাণ। রাধাকুমুদবাবু এসে বসলেন সোফায় যেখানে বসেছিলেন জ্ঞানবাবু, তাঁরই পাশে। মিনিট পাঁচেক পরে উনি জ্ঞানবাবুর কানে কানে প্রশ্ন করলেন, ‘কে বাজাচ্ছে তবলা, জানো?? ওঁর উত্তরের অপেক্ষা না করেই বললেন ‘জ্ঞান ঘোষ।’

রাধাকুমুদবাবু শুধু সরস্বতীর কৃপারই মূল্যায়ন করতেন না, লক্ষ্মীর অনুগ্রহও তাঁর কাছে সমান মূল্যবান ছিল, তাই চুপিচুপি সংযোজন করলেন,

‘খুব ভাল বাজায়। মস্ত বড়লোকের ছেলে। মিনিট চার-পাঁচ পরে জ্ঞানবাবুর বাঁ দিকের পাঁজরে একটি আঙুলের খোঁচা। প্রশ্ন, ‘তুমি কী কর??

‘আজ্ঞে, একটু-আধটু তবলা বাজাই, গান করি।’

‘আমার ছেলেও করে, যে-সে লোক নয় আমীর খাঁর কাছে শেখে, মস্ত ওস্তাদ। তা তুমি কার কাছে শেখ??

মাথা চুলকে জ্ঞানবাবু বললেন, ‘ওই যে আপনি যাঁর নাম বললেন, জ্ঞান ঘোষ, তাঁরই কাছে।

জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল আড্ডার, প্রধানত সাঙ্গীতিক আড্ডার। বয়সের অনেকটা পার্থক্য সত্ত্বেও নিজগুণে উনি আমায় স্নেহ করতেন এবং আমাকে ওঁর সর্বকনিষ্ঠ বন্ধুর স্থান দিয়েছিলেন। এ আড্ডার সূত্রপাত যখন উনি অল ইন্ডিয়া রেডিওয় তখন থেকে, যদিও পরিচয় ওর ডিকসন লেনের বাড়িতে বসবাসের সময় থেকেই।

আকাশবাণীর অনতিদূরেই আমি তখন এসপ্ল্যানেড ম্যানসনসের ফ্ল্যাটে থাকি। প্রায়ই উনি আসতেন, কখনও একা, কখনও বিমান ঘোষের সঙ্গে। একবার বন্ধের দিনে উনি দমদম থেকে হেঁটে এসেছিলেন মনে আছে। পরে ওর ওল্ড বালিগঞ্জ রোডের সরকারি বাসস্থানও আমার বাড়ির কাছেই ছিল। আমার বাড়িতে কিংবা অদ্রিজা মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে নিয়মিত আড্ডা হত। আমার গানের সঙ্গে হার্মোনিয়াম বাজিয়ে একাধিক আসরে উনি আমায় কৃতার্থ করেছেন।

 

পণ্ডিত ভীমসেন জোশী, ভীমসেন গুরুরাজ যোশী, ভারতীয় শাস্ত্রীয় কণ্ঠশিল্পী, কিরানা ঘরানা | Pandit Bhimsen Joshi, Bhimsen Gururaj Joshi, Indian Classical Vocalist, Kirana Gharana

 

সবাই জানে উনি উস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খাঁর গানের ভক্ত ছিলেন, আমীর খাঁরও। একদিন কথায় কথায় বললাম, ‘গোলাম আলি খাঁর গানে তো আমি শতকরা নব্বুই ভাগ গোয়ালিয়রই পাই, উনি নিজের মতো সাফসুতরো করে নিয়েছেন, শ্রুতিকটু অংশগুলি ওই গায়কির বাদ দিয়েছেন আর তার ওপর পড়েছে ওঁর ব্যক্তিত্বের ছাপ ‘। কথাটা জ্ঞানবাবুর মনে ধরেছিল এবং এ বিষয়ে আরও বিশদভাবে আলোচনাও পরে হয়। সঙ্গে উল্লাস কশলকরের গুরু গজানন রাও জোশি বেশ কয়েক বছর আগে কলকাতায় আসেন সঙ্গীত রিসার্চ আকাডেমির আমন্ত্রণে।

এই গজানন রাও সঙ্গীত জগতের এক অসাধারণ মানুষ। ইনি গোয়ালিয়রের তালিম পান ওঁর পিতা অন্ত বুয়া অর্থাৎ অনন্ত মনোহর জোশির কাছে, আগ্রার তালিম পান ওই ঘরানার মহাপণ্ডিত উস্তাদ বিলায়েত্ হুসেন খাঁর কাছে এবং জয়পুর ঘরানার তালিম নিয়েছিলেন ওই ঘরানার প্রবর্তক প্রবাদপ্রতিম উস্তাদ আল্লাদিয়া খাঁর ছেলে ভুর্জি খাঁর থেকে। ইনি সাধারণত গানের আসরে এই তিন গায়কি মেশাতেন না। এমনও হয়েছে উনি একই তিনটি রাগ তিনটি স্টাইলে গেয়েছেন, গোয়ালিয়রের শৈলীতে প্রথম রাগটি, দ্বিতীয়টি বিশুদ্ধ আগ্রার গায়কিতে এবং তৃতীয়টি আল্লাদিয়া খাঁর তৈরি জয়পুরি ঢঙে। মনে হত একই মানুষ কাপড় বদলে বদলে আসরে এসে বসছেন।

তালিমের গুণে এ ক্ষমতা বেশ কিছু অর্জন করেছেন বর্তমান প্রজন্মের উল্লেখযোগ্য খেয়াল সুগায়ক উল্লাস কশলকর, যাঁর উপস্থিতি কলকাতায় বহু বেতালিমের খেয়াল গায়কদের চক্ষুরুম্মীলনের সহায়তা করবে বলে আশা করছি। গজানন বুয়া। তাঁর শিষ্যের মতো সুকণ্ঠের অধিকারী ছিলেন না, তৈরীর অংশও নাওজোয়ান উল্লাসের তুলনায় কম ছিল। সম্ভবত এই কারণে তিনি বেহালা বাজানোয় মন দেন। উত্তর ভারতে উনিই প্রথম কলাকার যিনি রেডিওর ন্যাশনাল প্রোগ্রামে বেহালা এবং গানের প্রোগ্রাম দুইই করেছেন। দক্ষিণ ভারতে করেছেন বালমুরলী কৃষ্ণন।

 

ওস্তাদ আল্লাদিয়া খান

 

ফোর্ড ফাউন্ডেশনের ঘরানা প্রজেক্টের ভার আমার ওপর দেন সঙ্গীত রিসার্চ আকাডেমির ডিরেক্টর বিজয় কিসলু। সেই সূত্রে পুরনো টেপ ঘাঁটতে ঘাঁটতে গজানন বুয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে শুনলাম জ্ঞানবাবু আমার নাম উল্লেখ করে আমার উপযুক্ত মতের সমর্থন করে গজানন বুয়াকে প্রশ্ন এবং আলোচনা করেছেন। সে আসরে আমি উপস্থিত ছিলাম না।

ঘরানা প্রজেক্টের ওপর কাজ করতে করতে আমার ধারণা দৃঢ়তর হয়েছে যে, গোয়ালিয়র থেকেই বিভিন্ন ঘরানার সৃষ্টি হয়েছে। এর ঐতিহাসিক সমর্থন ছাড়াও শৈলীর এবং আঙ্গিকের দিক থেকে বহু মিল আবিষ্কার করেছি যার কিছু কিছু উল্লেখ আমি আমার প্রথম বই ‘কুদ্রত্ রঙ্গিবিরঙ্গী’তে করি। এ বইটি অবশ্যই ঘরানার ইতিহাস, কিন্তু সেই সঙ্গে আমার প্রচেষ্টা ছিল উত্তর ভারতের সঙ্গীত জগতের সৃজনীশক্তির ইতিহাস বা ক্রিয়েটিভিটির হিস্ট্রি লেখার। এ ছাড়াও শেষ পরিচ্ছেদটিতে আছে সমাজতাত্ত্বিকের চোখে হিন্দুস্থানি ক্রমবিবর্তন যা ধূর্জটিপ্রসাদের (১৯৪৫ সালে) পূর্বে বা পরে আমার জ্ঞানত কেউ করেননি।

১৯৪৫-এর পরে বিশাল পরিবর্তন ঘটেছে সামাজিক ও সঙ্গীতজগতে, সেই কারণে এই পরিচ্ছেদটির মূল্যায়ন করার ভার তাঁদের ওপর যাঁরা একাধারে সমাজতাত্ত্বিক ও সঙ্গীতজ্ঞ। বইটি যেহেতু বর্তমান প্রজন্মের বাঙালি পাঠকদের জন্য লেখা সেজন্য গাল-গল্পের রাংতার মোড়কে এই কেঠো বিষয়বস্তুকে পরিবেশন করতে হয়েছে। এর ফল হয়েছে মিশ্রিত। সাহিত্যিক মহল থেকে যথেষ্ট সাড়া পেলেও উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতজগৎ থেকে কোনও উচ্চবাচ্য শুনিনি এক পণ্ডিত রবিশঙ্কর ছাড়া। বছর চারেক আগে এক সাপ্তাহিকে সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে উনি আশাতিরিক্ত প্রশংসা করে আমার আত্মশ্লাঘা বর্ধন করেছেন। অন্য দিকে জ্ঞানবাবুরই প্রধান শিষ্য ‘শ্রুতিনন্দন’ নামক পুস্তকে লিখেছেন :

সংবাদপত্রে এবং সাময়িকপত্রে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত ও সঙ্গীত শিল্পীদের সম্বন্ধে মাঝে মাঝে ধারবাহিক কিছু রচনা থাকে। যেগুলিতে কোন শিল্পী বাড়িতে গরু পোষেন, কোন বিখ্যাত ওস্তাদ বালতি বালতি দুধ আর বস্তা বস্তা জিলিপি গিলে রেওয়াজে বসতেন, কে কোন আসরে কাকে ঘায়েল করেছিলেন—এসব গালগল্প থাকে। পরে আবার এসব লেখা বই আকারে বেরোলে ওই সব লেখকদের কিছু নাম ও প্রতিষ্ঠা হয়। সঙ্গীতের কিছুই হয় না।

 

কিশোরী আমোনকর

 

সঙ্গীত সমালোচনায় ও অন্যত্র অজ্ঞতা এবং আত্মবিশ্বাসের মিলিত ভূমিকা হাস্যকর কিন্তু ক্ষতিকর হয়। জীবিকার প্রয়োজনে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিম্নগামী প্রবৃত্তির শিকার হওয়ার বহু দৃষ্টান্ত আছে। এই ধরনের সমালোচকেরা সেই দৃষ্টান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি করেন—এ কথা কি ভুল? বহু যুগবাহিত ঐতিহ্যসমৃদ্ধ সঙ্গীত ও সঙ্গীতশিল্পীদের সম্পর্কে চটুল মন্তব্য না করে যদি কিছু চীজ বা গান (কম্পোজিশন) এবং বিগত যুগের উস্তাদ ও পণ্ডিতদের অনুশীলন পদ্ধতি ও তার প্রয়োগ সম্পর্কে কিছু মূল্যবান তথ্য উদ্ধার করার চেষ্টা করতেন তাহলে সঙ্গীতশিল্পী এবং অনুসন্ধিৎসু সঙ্গীতপ্রেমীদের উপকার হত।

হতাশ এবং বিস্মিত হলাম ব্যক্তিগত কারণে। লেখকের সাঙ্গীতিক বুদ্ধি ও প্রতিভার প্রশংসা আমি বরাবরই করে এসেছি। ওঁর বা ওঁর গুরুদেরও কখনও সমালোচনা করেছি বলে মনে পড়ে না। সময়াভাব ওঁর বিশেষ সমস্যা। কারণ ভাল করে বইটি পড়ার পর এ মন্তব্য করলে ওঁর মতো মানুষের সততার প্রতি সন্দিহান হতে হয়। অতএব সময়াভাব কাটিয়ে উনি গালগল্পের শ্যাওলাটি হটিয়ে দিয়ে দু-এক ডুব মারলে দেখতে পেতেন বিভিন্ন ঘরানার গায়কির বিশদ বিশ্লেষণ ছাড়াও ঘরানার তালিম ও স্বরপ্রয়োগ সম্পর্কে একাধিক জায়গায় আলোচনা করা হয়েছে, যেমনটি আমি আমার সারা জীবনে বহু উস্তাদের হুঁকো ভরা এবং পা টেপার মাঝে মাঝে মনোযোগ দিয়ে শুনেছি।

 

কিশোরী আমোনকর

 

ফোর্ড ফাউন্ডেশনের সূত্রে গত বিশ বছর ধরে যেসব উস্তাদের সাক্ষাৎকার সঙ্গীত রিসার্চ আকাডেমিতে আছে তাও যথেষ্ট রসদ জুগিয়েছে এবং আমার পুস্তকের ভূমিকায় আমি আকাডেমির ঋণ স্বীকার করেছি। আর গাল-গল্প? এ তো চলে আসছে পণ্ডিচেরীর দিলীপকুমার রায় ও অমিয়নাথ সান্যালের ‘স্মৃতির অতলে’র সময় থেকে। শ্রদ্ধেয় জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ মশায়ও তাঁর ‘তহজীব এ মৌসিকী’তে নানা গল্প শুনয়ে সাঙ্গীতিক স্মৃতিচারণ করেছেন।

তার মধ্যে আছে লোকমুখে শোনা কাহিনী পণ্ডিত ওঙ্কারনাথ ঠাকুরের তবলচিকে ঘুষ দিয়ে আসরে বেতালা করে নিজের লয়দারি প্রমাণ করা (বুকি এবং ক্রিকেটাররা আর কি অপরাধ করল?), উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর সঙ্গে তবলাসঙ্গতে কিভাবে জ্ঞানবাবুকে মোকাম বদলে দিয়ে আসরে উস্তাদ আলাউদ্দিন অপদস্থ করার চেষ্টা করেন এবং পরে শুনেছি ওঁর কাছে উকিলের চিঠি খেয়ে এবং ছেলে জামাইয়ের মধ্যস্থতায় মিটমাট হয়ে যায় ইত্যাদি ইত্যাদি।

বোঝাই যাচ্ছে এইসব মহাজনদের পদাঙ্ক অনুসরণ করার প্রচেষ্টা আমাদের মতো ক্ষুদ্র লোকের পক্ষে ঘোরতর অনুচিত। তবে ওঁদের লেখায়ও ‘শ্রুতিনন্দন’ -এর লেখক আমার কাছে যা প্রত্যাশা করেছেন তার ছিটেফোটাও দেখতে পাচ্ছি না। ‘কুরত্ রঙ্গিবিরঙ্গী’র ভূমিকায় আমি জানিয়েছিলাম ‘ইট ইজ আ সিরিয়াস বুক রিটুন ইন আ লাইটার ভেন।’ বিষয়বস্তুর গভীরতা এবং তথ্যবহুল বিশ্লেষণকে তাকের ওপর তুলে দিয়ে ‘লাইটার ভেন টাই একজন নামীদামী সঙ্গীতশিল্পীর কাছে বড় হয়ে উঠল দেখে দুঃখিত বোধ করছি।

 

কিশোরী আমোনকর

 

আনাতোল ফ্রাঁস বলতেন যদি আগামীকালের পাঠকদের কাছে পৌঁছতে চাও তো হালকা হয়ে ভ্রমণ করো, ট্র্যাভেল লাইট। এ ধরনের কোনও উচ্চাশা বা অহমিকা আমি পোষণ না করলেও কথাটা বাল্যকাল থেকেই আমার মনে ধরেছে। বার্নার্ড শ এবং বার্ট্রান্ড রাসেলও গুরুগম্ভীর বিষয়কে সরল ঝরঝরে। ভাষায় মনোগ্রাহী করে পেশ করার কায়দা রপ্ত করতে দ্বিধাবোধ করেননি। হয়তো বা বৃদ্ধ বয়সে আমাদের তথাকথিত চটুলতা পরবর্তী প্রজন্মের কাছে একটু বেশি বেমানান। ঠেকবে।

কলকাতায় ঝলমলে পাঁচতারা আর্টিস্ট এবং গলা ঘুরোনোর কদর হয়ে আসছে সলামৎ আলি নজাকৎ আলির আমল থেকে। ফলে আমাদের মতো নিছক তালিমপ্রাপ্ত গায়কদের চাহিদা গত বিশ বছরে তলানিতে এসে ঠেকেছে। তাই ‘যুগবাহিত ঐতিহ্যসমৃদ্ধ সঙ্গীত ও চীজ (কম্পোজিশন)’ শোনাবার একমাত্র রাস্তা বক্তৃতা এবং উদাহরণের (লেকচার ডেমনস্ট্রেশনের) মাধ্যমে। এও আমি উত্তর ও দক্ষিণ ভারতে বহু জায়গায় করেছি। এমন কি সঙ্গীত রিসার্চ আকাডেমিতেও, মনে পড়ছে, খেয়ালের অষ্টাঙ্গের ওপর বক্তৃতা করে পাঁচটি বিভিন্ন অঙ্গে (নট, বিলাবল, শুদ্ধ মহলার, খাম্বাজ ও কোমল গান্ধার যুক্ত) গৌড়মহলারের পুরনো একাধিক বন্দিশ সহকারে গান গেয়ে শুনিয়েছিলাম বছর তিনেক আগে।

সম্প্রতি চর্চা’ সিরিজে ‘জলসাঘরের উদ্যোগে গোয়ালিয়র জয়পুর কিরানা এবং সহসওয়ান’-এর ওপর বক্তৃতা করেছি পরপর তিনটি আসরে রেকর্ড ও টেপ বাজিয়ে। অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং গান গেয়েছিলেন যথাক্রমে উল্লাস কশলকর, কিরানা ঘরানার ফিরোজ দস্তুর ও ভীমসেন জোশি এবং সহসওয়ানের আফজল খাঁ ও রাসিদ খাঁ। বিড়লা সভাঘর এবং রামকৃষ্ণ মিশনের হলে এ আসরগুলি সাধারণ শ্রোতামহলেও জনপ্রিয় হয়েছিল এবং একটি টিকিটও পড়ে থাকেনি লক্ষ করে বিস্মিত হয়েছি। অতএব এ কর্তব্য আমি সম্পাদনা করার চেষ্টা করিনি এ অনুযোগও হয়তো ঠিক নয়। দুর্ভাগ্যবশত ‘শ্রুতিনন্দনে’র লেখক কোথাও উপস্থিত থেকে আমার উৎসাহ বর্ধন করেননি।

যাই হোক, জ্ঞানবাবুর প্রসঙ্গে ফিরে যাই। উনিই প্রথম আমায় ইংরেজির পাশাপাশি মাতৃভাষায় লিখতে বলেন। অসুস্থতার কারণে পুরো লেখাটা উনি পড়ে যেতে পারেননি। শেষ টেলিফোনে কথাবার্তা যখন হয় তখন আমি ‘কুরত্ রঙ্গিবিরঙ্গী’র উপসংহার লিখছি। শুনে উনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘কাকে কাকে সংহার করলেন?’ জবাবে বললাম ‘কাউকে নয়, কবির কথায় তোমরা সবাই ভাল।’ উনি আমায় সেই আদ্যিকালের স্টেটসম্যানের কলাম স্মরণ করিয়ে দিয়ে গীতা আউড়ে স্বধর্ম পরিত্যাগ করতে বারণ করেন। সেই আমার শেষ লম্বা কথাবার্তা জ্ঞানবাবুর সঙ্গে। ওঁর কথা মনে করেই আজ আবার কলম ধরেছি সঙ্গীত বিষয়ে আরও দু কথা লিখব ভেবে।

আমার পুরনো লেখার গালগল্পের জাল কাটিয়ে যেসব পাঠক তথ্য ও বিশ্লেষণের দরজায় পৌঁছতে অসমর্থ হয়েছেন বা দেখেও দেখেননি তাঁদের জন্য কিছু পুরাতন তথ্যই একত্রিত করে পেশ করবার চেষ্টা করব। ইতিমধ্যে কিছু মনন-চিত্তনের ফলে পুরনো কাসুন্দিতে আরও একটু মশলা যোগ করার ইচ্ছে আছে। তবে কসম খেয়েছি আর গালগল্প নয় এসব গম্ভীর বিষয় নিয়ে। আর যদি কোনও প্রগলভতার নিদর্শন পাঠক দেখেন তো তৎক্ষণাৎ লাইনগুলি না পড়ে, পরের অংশগুলিতে মন দিতে পারেন, কারণ সৈয়দ মুজতবা আলী ছাড়া আমাদের দেশে সবাই বিশ্বাস করেন পাণ্ডিত্য ও চটুলতা বিপরীতধর্মী।

আমি সামান্য একজন গায়ক মাত্র, তবে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া অনুসন্ধিৎসা আমাকে দু-একটি বিষয়ের গভীরে ঢুকতে প্ররোচনা দিয়েছে, যার ফলে কিছু লোক আমাকে সঙ্গীতবিদ্ আখ্যা দিয়ে গানের আসর থেকে পাকাপাকিভাবে রিটায়ার করবার জন্য তোড়জোড় করছেন। এককালে ম্যানেজমেন্টের জগতে ছিলাম। সেই সময়ের একটা প্রচলিত গল্প এই সূত্রে চটপট বলে নিয়ে আসল বিষয়ে মনোনিবেশ করব।

একটি প্রজনন কেন্দ্রের বলীবর্দ বার্ধক্যজনিত কারণে রিটায়ার করবেন। তিনি তো শোকাকুল। একে তো সকাল বিকেল ভাল খাওয়াদাওয়া তায় ‘জব্ স্যাটিসফ্যাকশন’ এমনই যে তিনি ধৃতরাষ্ট্রের মতো শত গোবৎসের জনক। অন্য দিকে রিটায়ার করলে বসিয়ে কে খাওয়াবে? এ তো কাশীর ষাঁড় নয়, এর গন্তব্য স্থান কসাইখানা।

এবংবিধ যখন তাঁর অবস্থা, তখন পাঁচ-সাতটি সহকর্মী একত্র হয়ে ওকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, ‘চিন্তা কোরো না ভায়া, আমরা একজিকিউটিভ কমিটির মিটিং ডাকছি, তোমায় আমরা ম্যানেজমেন্ট কনসালটেন্ট করে রাখব। তোমার এক্সপার্টিজ আমাদের কাছে অতি মূল্যবান।’ আমাদের দেশেও সঙ্গীতবিদ মানেই সঙ্গীতের জগতে দেশেও সঙ্গীতবিদ মানেই সঙ্গীতের জগতে বিফল নচেৎ অবসরপ্রাপ্ত গায়ক বা বাদক।

 

খেয়াল [ Kheyal ] গান সম্পর্কে আরও পড়ুন:

অন্যান্য সঙ্গীতের ধারা সম্পর্কে জানতে:

Leave a Comment