খুরশীদ আলম । বাংলাদেশী কন্ঠশিল্পী

খুরশীদ আলম একজন বাংলাদেশী কন্ঠশিল্পী। তিনি মানুষের মন, কি যে করি সহ অসংখ্য চলচ্চিত্রে কন্ঠ দেন। তার অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার ২০১৮ সালে তাকে রাষ্ট্রের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান একুশে পদক-এ ভূষিত করে।

চলচ্চিত্রে তিনি প্রথম গান গেয়েছেন ১৯৬৯ সালের ১ আগস্ট। বাবুল চৌধুরী পরিচালিত ‘আগন্তুক’ চলচ্চিত্রের সেই গানটি হলো ‘বন্দী পাখির মতো’। গানের কথা লিখেছেন ডা. আবু হায়দার সাজেদুর রহমান, সুর ও সংগীত পরিচালনা করেন আজাদ রহমান। ছবিতে গানটির সঙ্গে অভিনয় করেন রাজ্জাক। গানটি তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। এরপর মো. খুরশীদ আলম কণ্ঠ দিয়েছেন পাঁচ শতাধিক গানে। এর মধ্যে বেশির ভাগ গানই চলচ্চিত্রের। জনপ্রিয় হয়েছে অসংখ্য গান।

খুরশীদ আলম । বাংলাদেশী কন্ঠশিল্পী

জন্ম ও শৈশব

খুরশীদ আলম এর জন্ম ১লা আগষ্ট, ১৯৪৬ সাল । জন্ম জয়পুরহাটের কালাই উপজেলায় । বাবার নাম এ, এফ তসলিমদ্দিন আহমেদ । মায়ের নাম মেহেরুননেছা ।

এই গুণী কণ্ঠশিল্পীর শৈশব বেড়ে ওঠে পুরানা ঢাকায় । ১৯৬৭ সালে কলেজ অব মিউজিক থেকে ডিগ্রী অর্জন করেন । ঐ বছর থেকেই রেডিও ও বাংলাদেশ টেলিভিশনে গান গেয়ে আসছেন । তিনি প্রথম ১৯৬৯ সালে “আগন্তক” সিনেমায় প্রথম প্লেব্যাক করেন । আলাউদ্দীন রোডে হাজীর বিরিয়ানির পাশেই ছিল বাসা। তিন ভাই, দুই বোনের মধ্যে সবার বড় খুরশীদ আলম।

তিন ভাই খুরশীদ আলম, মুরশিদ আলম, সরোয়ার আলমের মধ্যে খুরশীদ আলম বড়। ছোটবেলা থেকেই খুরশীদ আলমের সঙ্গীতের প্রতি আকর্ষণ ছিল। পরিবারের তেমন কেউ সঙ্গীতের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। চাচা ডা. সাজেদুর রহমান টুকটাক রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইতেন। আর চাচার কাছেই সঙ্গীতের হাতেখড়ি খুরশীদ আলমের।

খুরশীদ আলম । বাংলাদেশী কন্ঠশিল্পী

সঙ্গীতে পদার্পণ

স্কুল জীবনে গানের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিতেন তিনি। স্কুল বন্ধুদের অনুপ্রেরণায় তার সঙ্গীতে পদার্পণ। তার স্ত্রী রীনা আলম এবং দুই মেয়ে মেহরিন আলম ও মেহনাজ আলম। গান নিয়ে কেটে যায় তার সারাদিন। অবসরে গান শোনেন, ক্রিকেট খেলা দেখেন। তিনি আজিমপুরের ওয়েস্টিন হাইস্কুলে পড়তেন। তার শিক্ষা জীবন কাটে নবাবপুর গভর্নমেন্ট হাই স্কুল, কলেজ অফ মিউজিক এবং তৎকালীন সরকারি জগন্নাথ কলেজে (বর্তমানে জগন্নাথ ইউনিভার্সিটি)।

“চুমকি চলেছে একা পথে, সঙ্গী হলে দোষ কি তাতে..”

এই গানের জনপ্রিয় গায়কের কণ্ঠের জাদুকর মোহাম্মদ খুরশীদ আলম। যিনি দরদমাখা কণ্ঠে গান গেয়ে চলেছেন আজ পর্যন্ত। মাগো মা ওগো মা, চঞ্চল দুনয়নে, আজকে না হয় ভালোবাসো, ও দুটি নয়নে স্বপন চয়নে, চুমকি চলেছ একা পথে সহ অসংখ্য কালজয়ী গানের শিল্পী মোহাম্মদ খুরশীদ আলম। তার দীর্ঘ ক্যারিয়ারে ৪২৫টি চলচ্চিত্রে হাজারের বেশী গান গেয়েছেন তিনি।

১৯৬১-৬২ সালে জাতীয় আধুনিক সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় এবং ১৯৬২-৬৩ সালে জাতীয় রবীন্দ্র সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় প্রথম হন তিনি। বাংলাদেশ বেতারে আধুনিক গানের অডিশন দিতে এসে পরিচয় হয় প্রখ্যাত সঙ্গীত পরিচালক সমর দাসের সঙ্গে । সমর দাস তাকে নিয়ে গেলেন সঙ্গীতের ওপর বিশেষ শিক্ষা দেয়ার জন্য। তিনি তাকে শিখিয়েছেন কিভাবে কোন বিখ্যাত শিল্পীকে অনুসরণ করে ভালো গান করা যায়। তিনি তাকে প্রায় ছয় মাস সঙ্গীতের ওপর জ্ঞান দান করেন। এরপর আজাদ রহমানের সঙ্গে সঙ্গীত নিয়ে দুই বছর কাজ করেন তিনি।

খুরশীদ আলম । বাংলাদেশী কন্ঠশিল্পী

চলচ্চিত্র ও আধুনিক গানের শিল্পী হলেও মো. খুরশীদ আলমের শুরুটা হয়েছিল রবীন্দ্রসংগীত দিয়ে। ১৯৬৫ সালে শেখ বোরহান উদ্দিন কলেজে প্রথম গেয়েছিলেন রবীন্দ্রসংগীত। ১৯৬৫ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার রবীন্দ্রসংগীত গাওয়া বন্ধ করে দেয়। তাই রেডিওতে আধুনিক গানের শিল্পী হওয়ার জন্য অডিশন দেন। রেডিওতে বাণিজ্যিক কার্যক্রমে তাঁর গাওয়া প্রথম দুটি গান হলো ‘তোমার দু হাত ছুঁয়ে শপথ নিলাম’ ও ‘চঞ্চল দু নয়নে বলো না’।

১৯৬৭ সালে কবি সিরাজুল ইসলামের (প্রয়াত) লেখা এবং আজাদ রহমানের সুরে কণ্ঠ দেন একটি আধুনিক গানে। যেই গানের কথা হলো তোমার দু-হাত ধরে শপথ নিলাম। সে সময়ে গানটি তৎকালীন পুরো পাকিস্তানে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। বর্তমানেও গানটি বেশ জনপ্রিয়। সে বছরই তার কণ্ঠে আরেকটি আলোড়ন সৃষ্টিকারী গান হলো- ‘‘চঞ্চল দু’নয়নে বলো না কি খুজছো ?’’ মোহাম্মদ খুরশীদ আলম প্রথম প্লে ব্যাক করেন ১৯৬৯ সালে বাবুল চৌধুরীর পরিচালনায় এবং ইফতেখারুল আলমের প্রযোজনায় আগন্তুক মুভিতে। ১৯৬৯ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে তিনশ মুভির গানে কণ্ঠ দিয়েছেন তিনি। উল্লেখ্য, তিনি লালুভুলু মুভির সাতটি গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। সেই মুভিটিকে চারটি ভাষায় রূপান্তরিত করা হয়েছিল।

খুরশীদ আলম ষাটের দশক থেকে বাংলা চলচ্চিত্রাঙ্গনের গানের ভান্ডারকে করেছেন সমৃদ্ধ। এখনও অব্যাহত আছে তার ক্লান্তিহীন সঙ্গীত সাধনা। বাংলা সিনেমার সুবর্ণ সময়ের একজন খ্যাতিমান প্লে-ব্যাক সিঙ্গার খুরশিদ আলম। একটা সময় ছিল বাংলা সিনেমার গান মানেই খুরশিদ আলম। বাংলা চলচ্চিত্র সংগীতকে তিনি অনেক কিছু দিয়েছেন। সাবিনা ইয়াসমিনের সঙ্গে সর্বাধিক গান গেয়েছেন কণ্ঠশিল্পী খুরশিদ আলম।

খুরশীদ আলম । বাংলাদেশী কন্ঠশিল্পী

উল্লেখযোগ্য গান

খুরশীদ আলমের গাওয়া অনেক গান রয়েছে জনপ্রিয়তার তালিকায়। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-

‘সমাধান’ ছবির ‘মাগো মা ওগো মা, আমারে বানাইলি তুই দিওয়ানা’। গানটির গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার, সুরকার ও সংগীত পরিচালক সত্য সাহা। মো. খুরশীদ আলম জানান, তাঁর খুব পছন্দের গানের মধ্যে রয়েছে ‘ও দুটি নয়নে’, ‘আলতো পায়ে’, ‘বাপের চোখের মণি নয়’, ‘চুরি করেছ আমার মনটা’, ‘ধীরে ধীরে চল ঘোড়া’, ‘চুমকি চলেছে একা পথে’, ‘বন্ধু তোর বরাত নিয়া আমি যাব’, ‘আজকে না হয় ভালোবাস আর কোনো দিন নয়’, ‘এই আকাশকে সাক্ষী রেখে’, ‘পাখির বাসার মতো দুটি চোখ তোমার’, ‘বন্দী পাখির মতো’ গানগুলো। তাঁর খুব ভালো লাগার একটি গান রাজ্জাক পরিচালিত ‘অনন্ত প্রেম’ ছবির ‘ও চোখে চোখে পড়েছে যখনই’। গানের কথা লিখেছেন আহমেদ জামান চৌধুরী, সুর ও সংগীত পরিচালনা করেন আজাদ রহমান।

প্লেব্যাক

নায়করাজ রাজ্জাক অভিনীত ছবিতে বেশি গান গেয়েছেন মো. খুরশীদ আলম। এ ছাড়া রহমান, ওয়াসিম, জাফর ইকবাল, সোহেল রানা, ইলিয়াস কাঞ্চনসহ বিভিন্ন চিত্রনায়কের ছবিতে প্লেব্যাক করেছেন।

আরও দেখুনঃ

FacebookTwitterEmailShare