কবিগানের স্তবক ও সুর [ Stanza & Tune of Kavigan, Kobi Gaan, Kobi Lorai or Kabigan ] : মালশি থেকে লহর কবি পর্যন্ত কবিগানের গঠন সব অঞ্চলে প্রায় এক রকম। কিন্তু গানগুলোর স্তবক-নাম বা তুক-নামগুলো এক-এক অঞ্চলে এক-এক রকম। এর মধ্যে কলকাতা এবং ময়মনসিংহ অঞ্চলে তুকনামের সংখ্যা কম। কিন্তু উভয় অঞ্চলের তুকনাম ও তুকের বিন্যাস আলাদা।
অন্যদিকে দক্ষিণবঙ্গ (বৃহত্তর যশোর, খুলনা, বরিশাল ও ফরিদপুর) এবং ঢাকা অঞ্চলের তুকনামের সংখ্যা বেশি। এই দুই অঞ্চলের তুকনামের মধ্যে সাদৃশ্যও বেশি।
বস্তুত ঢাকা এবং দক্ষিণবঙ্গের কবিগানের প্রায় প্রতিটি চরণ আলাদা নামে চিহ্নিত। তবে এ কথাও স্মরণীয় যে, হরিচরণ আচার্য যখন তাঁর ‘কবির ঝঙ্কার’ বই প্রকাশ করেছিলেন, তখন এইসব তুককে তিনি মোট চারটি তুক দিয়ে প্রকাশ করেছিলেন। পরের পৃষ্ঠার সারণিতে তুকনামগুলোর এই বৈচিত্র্য দেখা যেতে পারে। (তুকনামের বৈচিত্র্য সারণি দ্রষ্টব্য)
অঞ্চলভেদে তুকনাম কম-বেশি হলেও গানের দৈর্ঘ্য সব অঞ্চলে প্রায় সমান। তাই ইচ্ছা করলে কলকাতা পর্বের কবিগান যেমন দক্ষিণবঙ্গ ও ঢাকা অঞ্চলের তুকনাম দিয়ে প্রকাশ করা যায়, একইভাবে ময়মনসিংহ অঞ্চলের কবিগানও কলকাতার তুকনাম দিয়ে উপস্থাপন করা সম্ভব।
Table of Contents
কবিগানের স্তবক ও সুর : তুকনামের বৈচিত্র্য সারণি
=================================
ঢাকা [ Dhaka ]
=============
১. চিতান, ২. পাড়ন, ৩. ফুকার, ৪. মিল, ৫. ধুয়া, ৬. ডাইনা, ৭. খাদ, ৮. দ্বিতীয় ফুকার, ৯. মিল, ১০. অন্তরা, ১১. পরচিতান, ১২. পরপাড়ন, ১৩. শেষ ফুকার
কলকাতা [ Kolkata ]
==============
১. চিতান, ২. পরচিতান, ৩. ফুকা, ৪. মেলতা, ৫. মহড়া, ৬. শাওয়ারি, ৭. খাদ, ৮. দ্বিতীয় ফুকা, ৯. দ্বিতীয় মেলতা, ১০. অন্তরা
দক্ষিণবঙ্গ [ South Bengal ]
=============
১. ধরন, ২. পাড়ন, ৩. ফুকার, 8. মিশ, ৫. মুখ, ৬. প্যাচ, ৭. মিশ, ৮. মুখ, ৯. খোচ, ১০. দ্বিতীয় ফুকার, ১১. মিশ, ১২. মুখ, ১৩. অন্তরা, ১৪. পরচিতান, ১৫. শেষ ফুকার, ১৬. শেষ মিশ
ময়মনসিংহ [ Mymensingh ]
============
১. চিতান, ২. পরচিতান, ৩. মিল, ৪. মহড়া, ৫. ধুয়া, ৬. খাদ, ৭. লহর, ৮. ঝুমুর
কবিগানের স্তবক ও সুর বিষয়ের এ পর্যায়ে আলোচনা তুকনামের সংখ্যা নিয়ে। তুকনামের সংখ্যা এতোগুলো হলেও সুরের বিবেচনায় গানের স্তবকসংখ্যা সর্বোচ্চ সাতটি পর্যন্ত হয়, যথা:
সুরের বিবেচনায় কবিগানের স্তবক সংখ্যা [ Stanza considering the Tune ]:
১/ চিতান (কলকাতা), চিতান/ পরচিতান (ঢাকা), ধরন/ পরচিতানের প্রথম অংশ (দক্ষিণবঙ্গ), চিতান (ময়মনসিংi)
২/ পরচিতান (কলকাতা), পাড়ন / পরপাড়ন (ঢাকা), পাড়ন/ পরচিতানের দ্বিতীয় অংশ (দক্ষিণবঙ্গ), পরচিতান (ময়মনসিংহ)
৩/ ফুকা+মেলতা (কলকাতা), ফুকার+মিল (ঢাকা), ফুকার+মিল (দক্ষিণবঙ্গ), মিল (ময়মনসিংহ)
৪/ মহড়া+শাওয়ারি (কলকাতা), ধুয়া+ডাইনা (ঢাকা), মুখ+প্যাচ+মিশ/ ছুট্টি (দক্ষিণবঙ্গ), ধুয়া (ময়মনসিংহ)
৫/ শাওয়ারি (কলকাতা), ডাইনা (ঢাকা), প্যাচ+মিশ/ছুট্টি (দক্ষিণবঙ্গ), ধুয়ার শেষাংশ (ময়মনসিংহ)
৬/ খাদ (কলকাতা), খাদ (ঢাকা), খোচ (দক্ষিণবঙ্গ), খাদ (ময়মনসিংহ)
৭/ অন্তরা (কলকাতা), অন্তরা (ঢাকা), অন্তরা (দক্ষিণবঙ্গ), ঝুমুর (ময়মনসিংহ)
কবিগানের স্তবক ও সুর বিষয়ের এ পর্যায়ে আলোচনা কবিগানের এই স্তবকগুলোর সম্ভাব্য ব্যুৎপত্তি নিয়ে। কবিগানের এই স্তবকগুলোর সম্ভাব্য ব্যুৎপত্তি নিয়ে আলোচনা করেন প্রফুল্লচন্দ্র পাল। তাঁর ধারণা ‘চিতেন’ শব্দটি ‘চিত্র’ এবং ‘তেন’ সহযোগে তৈরি।
চিতেনের পরবর্তী ‘আভোগ’ অংশকে চিতেনের সাদৃশ্যে ‘পরচিতেন’ বলা হয়। উদগ্রাহকের নামান্তর ‘মহড়া’। ধ্রুবপদের নামান্তর ‘ধুয়া’। মেলাপক থেকে ‘মেলতা’ শব্দের উদ্ভব। অন্তরার পরিবর্তিত নাম ‘খাদ’ ও ‘ফুকা’। এছাড়া পাঠ থেকে ‘পাড়ন’ এবং তাল থেকে ‘দোলন’ শব্দের জন্ম হওয়া সম্ভব।
বস্তুত উদগ্রাহক, মেলাপক, আভোগ, ধ্রুবপদ ও অন্তরা—গানের এই পঞ্চাঙ্গ পশ্চিমবঙ্গ ও পূর্ববঙ্গের কবিগানে কী কী নাম ধারণ করে, সে সম্পর্কে তাঁর মতামত পরবর্তী পৃষ্ঠার সারণিতে উপস্থাপন করা হলো। প্রফুল্লচন্দ্র পালের এই অনুমানে কিছু কষ্টকল্পনা লক্ষণীয়।
তাছাড়া প্রফুল্লচন্দ্র পাল প্রধানত পশ্চিমবঙ্গীয় কবিগানের তুকগুলো নিয়ে ভেবেছিলেন, পূর্ববঙ্গ পর্বের তুকনামগুলো সেভাবে আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠেনি। তবে কবিগানের তুকগুলোর সঙ্গে গানের পঞ্চাঙ্গ বিভাজনের সম্পর্ক নিয়ে তিনিই প্রথম চিন্তা করেন।
কবিগানের স্তবক ও সুর : কবিগানের পঞ্চাঙ্গ সারণি
================================
পঞ্চাঙ্গের নাম———————কলকাতা পর্বের রুপ———————-পূর্ববঙ্গের রূপ
========================================================
উদগ্রাহক ———————– চিতান বা মহড়া পরচিতান ————— চিতান/ ধরন পাড়ন
মেলাপক ———————– খাদ/ফুকা —————————— প্রথম ফুকার
আভোগ ———————— মেলতা চিতেন/পড়তা/দোলন/সওয়ারি —— মুখ, প্যাচ, খোচ
ধ্রুবপদ ————————- ধুয়া ———————————– দ্বিতীয় ফুকার, পরখোচ, পরচিতান
অন্তরা ————————– অন্তরা/খাদ/ফুকা ———————— অন্তরা
উৎস: প্রফুল্লচন্দ্র পাল, প্রাচীন কবিওয়ালার গান (কলকাতা: কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৫৮), পৃ. বাষট্টি, ছেষট্টি–সাতষট্টি।
কবিগানে রাগের ব্যবহার :
সিরাজুদ্দীন কাসিমপুরীর ধারণা বিশুদ্ধ কবিগান ‘কেঁকি’ রাগিণীতে গীত হতো। ২৪ কিন্তু এই নামের কোনো রাগিণী সংগীতশাস্ত্রে পাওয়া যায় না। তাছাড়া বিশুদ্ধ কবিগান বলতে কী বোঝায়, সেটাও স্পষ্ট নয়।
বাস্তবে কবিগানের সুর মিশ্র সুর। এর মধ্যে কীর্তনের সুর রয়েছে, রয়েছে শ্যামাসঙ্গীতের সুর, রয়েছে বাউল-ভাটিয়ালি প্রভৃতি গানের সুর। তাছাড়া কবিগানের ডাকগান এবং ধুয়া গান কখনো কখনো রাগিণী-নির্ভর হলেও মূল কবিগান মিশ্র রাগিণীর।
উনিশ শতকের পাঁচালি গান ও টপ্পা গান সাধারণত আড়ানা বাহার, আলেয়া, আশা ভৈরবী, ইমন, ইমন কল্যাণী, ইমন ঝিঝিট, ইমন ভূপালী, এলাইয়া, কল্যাণী, কানেড়া, কামোদ, কামোেদ খাম্বাজ, কামোদ গোড়া, কামোদ গৌড়, কালাংড়া, কেদারা, কেদারা কামোদ, কেদারা খাম্বাজ, খট, খটভৈরবী, গারা ঝিঝিট, গুর্জরী টোড়ী ব্যবহার হতো।
এছাড়া ব্যবহার হয়েছে রাগ- গৌরী, ছায়ানট, ঝিঝিট, ঝিঁঝিট খাম্বাজ, ঝিঝিট পিলু, জয়জয়ন্তী, টোড়ী, দরবারী কানাড়া, দরবারী টোড়ী, ধানেশ্রী পুরিয়া, পঞ্চম, পরজ, পাহাড়ী ঝিঁঝিট, পূরবী, বাগেশ্রী, বাগেশ্রী কানাড়া, বাগেশ্রী মুলতানী, বারোয়া, বাহার, বিভাস, বিভাস কল্যাণ, বেহাগ, বেহাগ ঝিঝিট, বেহাগ সরফরদা।
এছাড়া ব্যবহার হয়েছে রাগ- ভীমপলাশি বাহার, ভৈরবী, মালকোষ, মালসী, মুলতান, মুলতানী, মোহিনী, রামকেলী ললিত, লগনী, ললিত, ললিত বিভাস, শ্যাম, শ্যাম পূরবী, সরফরদা, সরফবদা কালাংড়া, সিন্ধু, সিঙ্গু কাফী, সিন্ধু খাম্বাজ, সিন্ধু ভৈরবী, সুরট, সুরট মল্লার, সোখরাই বাহার, সোহিনী, সোহিনী কানাড়া, হাম্বির, হিন্দোল । [২৪]
সমকালীন কবিগানের পাঁচালি অংশ এবং ডাক, টপ্পা ও ধুয়া গানগুলোতে এসব রাগিণীর প্রয়োগ ঘটা সম্ভব। যেমনটা পূর্বে দেখা গেছে, রাজেন্দ্রনাথ সরকার তাঁর ডাকগানগুলোতে এর মধ্যকার অনেকগুলো রাগের প্রয়োগ ঘটিয়েছিলেন।
[২৪ সিরাজুদ্দীন কাসিমপুরী, বাংলাদেশের লোকসংগীত পরিচিতি (ঢাকা: বাংলা একাডেমী, ১৯৭৩), পৃ. ২৩৪।]
কবিগানে তাল :
কবিগানের তাল বিভিন্ন রকমের হয়। অনেক সময়ে স্তবকান্তরে তালের পরিবর্তন করা হয়। ব্যবহৃত তালগুলোর মধ্যে আড়খেমটা, আড়া, একতালা, কাওয়ালি, কাশ্মীরি, কাহারবা, খেমটা, ঝাঁপতাল, ঠুংরি, তেওট, তেতালা, তেলেনা, ধামার, পোস্তা, মধ্যমান, যৎ, হরি প্রভৃতি তাল অধিক জনপ্রিয়। নির্দিষ্ট কোনো গানের জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো তাল নেই। অনেক সময়ে ঢুলির ইচ্ছা অনুযায়ী এসব তালের পরিবর্তন ঘটতে পারে অথবা লয় দ্রুত (জলদ) বা ঢিমে হতে পারে।
[ সূত্র: প্রফুল্লচন্দ্র পাল, প্রাচীন কবিওয়ালার গান (কলকাতা: কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৫৮); স্বরোচিষ সরকার, “কবিগান: উত্তরাধিকার ও স্বাতন্ত্র্য,” বাংলা একাডেমী বৈশাখী লোক উৎসব প্রবন্ধ ১৪০০ (ঢাকা: বাংলা একাডেমী, ১৯৯৩); দীনেশচন্দ্র সিংহ, পূর্ববঙ্গের কবিগান সংগ্রহ ও পর্যালোচনা (কলকাতা: কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৯৭)। ]
প্রফুল্লচন্দ্র পাল, প্রাচীন কবিওয়ালার গান (কলকাতা: কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৫৮), পৃ. ছেষট্টি—সাতষট্টি।
২৫ দাশরথি রায়ের পাঁচালি এবং নিধুবাবুর টপ্পায় এসব রাগিণীর উল্লেখ পাওয়া যায়। দাশরথি রায়ের পাঁচালির জন্য দ্রষ্টব্য, চন্দ্রশেখর মুখোপাধ্যায়, রসভাণ্ডার (কলকাতা: বসুমতী, ১৮৯৯); নিধুবাবু বা রামনিধি গুপ্তের টপ্পার জন্য দ্রষ্টব্য, নিরঞ্জন চক্রবর্তী, ঊনবিংশ শতাব্দীর কবিওয়ালা ও বাংলা সাহিত্য, পৃ. ২৯৪–৩৩৫] ]
লেখক :
স্বরোচিষ সরকার [ Shorochish Sarkar]
বিশিষ্ট আভিধানিক ও বৈয়াকরণ
অধ্যাপক, ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ।
লেখক : কবিগানের স্বরূপ ও প্রকৃতি
এই বিষয়ে অন্য গুরুত্বপূর্ণ আর্টিকেলগুলো দেখুন :
এ বিষয়ে অন্যান্য লিংক:
- উইকিপিডিয়া : কবিগান
15 thoughts on “কবিগানের স্তবক ও সুর [ Stanza & Tune of Kavigan, Kobi Gaan, Kobi Lorai or Kabigan ]”