[ADINSERTER AMP] [ADINSERTER AMP]

ভারতীয় উপমহাদেশের শাস্ত্রীয় সঙ্গীত সূচি

ভারতীয় উপমহাদেশের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের চর্চা ভারতে বৈদিক যুগ থেকে চলে আসছে। সামবেদে সঙ্গীতকে একটি পূর্ণাঙ্গ ও বিস্তারিত বিষয় হিসেবে আলোচনা করা হয়েছে। প্রায় ২০০০ বছরের পুরোনো এই চর্চা মূলতঃ মন্দিরে পরিবেশিত স্তোত্র হতেই সৃষ্টি হয়েছে। সামবেদে সঙ্গীতকে একটি পূর্ণাঙ্গ ও বিস্তারিত বিষয় হিসেবে আলোচনা করা হয়েছে।

 

ওস্তাদ আল্লাদিয়া খান

 

ভারতীয় উপমহাদেশের শাস্ত্রীয় সঙ্গীত সূচি

ভারতীয় উপমহাদেশের শাস্ত্রীয় সংগীত বৈদিক যুগ থেকেই প্রচলিত। চারটি বেদের অন্যতম সামবেদ সংগীতের মাধ্যমে বিভিন্ন যজ্ঞাদিতে পরিবেশিত হত। রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ ছাড়াও বিভিন্ন পালি প্রাকৃত, সংস্কৃত সাহিত্যে এবং মন্দিরগাত্রের ভাস্কর্যে প্রচুর সংগীতচর্চার উদাহরণ পাওয়া যায়। পুরাণে গন্ধর্বরা সংগীতে পারদর্শিতার জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে ভরতমুনি তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ নাট্যশাস্ত্র-এ সঙ্গীতের বিভিন্ন নিয়মাবলী লিপিবদ্ধ করেন। খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতকে শার্ঙ্গদেব সঙ্গীতরত্নাকর গ্রন্থে সমসাময়িক প্রচলিত রাগ, তাল ও তাদের প্রয়োগ সম্বন্ধে বিস্তারিত রচনা করেন। এই সময় পর্যন্ত সারা ভারতে একই প্রকার সংগীত প্রচলিত ছিল।

এরপরে মধ্যযুগে দ্বাদশ শতক থেকে আফগান ও মুঘল শাসকদের সময়ে উত্তর ভারতে শাস্ত্রীয় সংগীতের উপর পারস্যদেশীয়, আরব্য ও ইসলামিক সুরের প্রভাব পড়তে দেখা যায়। কিন্তু দক্ষিণ ভারতে শাস্ত্রীয় সংগীত প্রায় অবিকৃত থাকে। এই ভাবেই হিন্দুস্থানী ও কর্ণাটকি দুইটি পৃথক শাস্ত্রীয় সংগীতের সৃষ্টি হয়। বলা হয়, কর্ণাটক সংগীত ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সংগীতের আদি রূপ। ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকে এই দুই শাস্ত্রীয় সংগীতের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য দেখা দিতে শুরু করে ও ক্রমশ পরস্পরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

ভারত এক বৈচিত্র্যময় উপমহাদেশ । তবে প্রধানত উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের মধ্যে সংস্কৃতি, পোশাক, ভাষা, খাদ্যাভ্যাস প্রভৃতি ক্ষেত্রে বিস্তর পার্থক্য দেখা যায়। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। ভারতীয় সঙ্গীত মূলত দুই ভাগে ভাগ করা যায় – উত্তর ভারতীয় বা হিন্দুস্থানী সংগীত ও দক্ষিণ ভারতীয় বা কর্ণাটক বা কর্ণাটি সঙ্গীত। কর্ণাটক সঙ্গীত প্রধানত দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলিতে অর্থাৎ কর্ণাটক, অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা, তামিলনাড়ু, কেরলে প্রচলিত।

 

ভারতীয় উপমহাদেশের শাস্ত্রীয় সঙ্গীত সূচি

 

হিন্দুস্থানী সঙ্গীত [ Hindustani Classical Music ]:

হিন্দুস্তানী সঙ্গীতের মূল প্রেরণা এসেছে হিন্দু ধর্মে নব রস থেকে। এই সঙ্গীতের প্রচলন মূলত উত্তর ভারতে দেখা যায়।

 

কর্ণাটী সঙ্গীত [ Carnatic Classical Music ]:

কর্ণাটকী উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত বা কর্ণাটকী সঙ্গীত হচ্ছে ভারতীয় উচ্চাঙ্গ শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আদিতম রূপ। দক্ষিণ ভারতে উদ্ভূত কর্ণাটকী সঙ্গীত হচ্ছে পৃথিবীর প্রচীনতম সঙ্গীতসমূহের একটি।

বিস্তারিত পড়ুন ….

ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের পরিবেশনা হয় মূলত দু’ভাবে – কন্ঠে ও বাদ্যযন্ত্রে। হিন্দুস্থানী ও কর্ণাটী সঙ্গীতের কিছু কাঠমোগত বৈশিষ্ট ও রীতি রয়েছে। উভয় ধরণের সঙ্গীতেই রয়েছে দুটি মৌলিক উপাদান যা তাল ও রাগ হিসেবে আমাদের কাছে পরিচিত।

 

ওস্তাদ ফাইয়াজ খান, আগ্রা ঘরানা

 

হিন্দুস্তানি ও কার্নাটাকা শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের কিছু পার্থক্য:

১। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ষড়জ, ঋষভ, গান্ধার, মধ্যম, পঞ্চম, ধৈবত, নিষাদ (সা, রি, গা, মা, পা, দা, নি) এই সাতটি স্বর ও পাঁচটি বিকৃত স্বর নিয়ে গঠিত। তবে কর্ণাটকি ও হিন্দুস্থানী সঙ্গীতে স্বরের নামকরণে পার্থক্য দেখা যায়। এছাড়াও কর্ণাটক সঙ্গীতে অতিরিক্ত চারটি বিবাদী স্বর ব্যবহৃত হয়, যা হিন্দুস্থানী এমনকি পাশ্চাত্য সঙ্গীতেও দেখা যায় না।

২। কর্ণাটক সঙ্গীতে স্বরগুলিকে আন্দোলিত করে গাওয়া হয়, বা বলা যায় , কম্পিতম গমকের প্রয়োগ খুব বেশি হয়। হিন্দুস্থানী সঙ্গীতে প্রতিটি স্বর স্পষ্টভাবে উচ্চারিত হয়, কিছু ক্ষেত্রে মীড় প্রয়োগ করা হয়, অর্থাৎ একটি স্বর থেকে অন্য স্বরে ঢেউ খেলিয়ে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়।

৩। কর্ণাটক সঙ্গীত মূলত দক্ষিণ ভারতীয় ভাষায়, যেমন কন্নড়, তেলেগু, তামিল, মালায়লাম ইত্যাদি ভাষায় গাওয়া হয়। হিন্দুস্থানী সঙ্গীত হিন্দি, পাঞ্জাবি, রাজস্থানী, ব্রজ/বৃজ ভাষায় গাওয়া হয়। তবে দুই পদ্ধতিতেই সংস্কৃত ভাষায় গাওয়া হয়ে থাকে।

৪। কর্ণাটক সঙ্গীত প্রধানত তানপুরা, ঘটম, কাঞ্জিরা, মৃদঙ্গ, সরস্বতী বীণা, নাগস্বরম প্রভৃতি সহযোগে পরিবেশন করা হয়। উনিশ শতকে ব্রিটিশ আমলে বালাস্বামী দীক্ষিতার পাশ্চাত্য সঙ্গীত দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে কর্ণাটক সঙ্গীতে ভায়োলিন বা বেহালা ব্যবহার শুরু করেন। অতিরিক্ত গমক বা অলংকার ব্যবহারের জন্য কর্ণাটক সঙ্গীতে হারমোনিয়াম বা কীবোর্ড ব্যবহার করা কঠিন, এই কারণে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সঙ্গীতজ্ঞরা তার জাতীয় বাদ্য পছন্দ করে থাকেন। হিন্দুস্থানী সঙ্গীত সাধারণত তানপুরা, সেতার, তবলা, পাখোয়াজ, হারমোনিয়াম প্রভৃতি সহযোগে গাওয়া হয়।

৫। কর্ণাটক সঙ্গীতে গানের সাহিত্যম বা lyrics এর উপর অনেক গুরুত্ব দেওয়া হয়। সাহিত্যম সাধারণত বেশ কিছুটা দীর্ঘ হয় ও এর বিভিন্ন অংশ পল্লবী, অনুপল্লবী, চরণাম প্রভৃতি নামে ভাগ করা হয়। হিন্দুস্থানী সঙ্গীত অনেক সংক্ষিপ্ত হয়, এর বন্দিশের প্রধানত দুই ভাগ- স্থায়ী ও অন্তরা। এখানে রাগের উপর বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়।

৬। কর্ণাটক সঙ্গীতের মূল ভিত্তি হল ভেঙ্কটমুখী প্রবর্তিত মেলকর্তা পদ্ধতি। সা, রি, গা, মা, পা, দা, নি মূল সাতটি ও তাদের বিভিন্ন রূপ সহ মোট ১৬টি স্বরের বিভিন্ন রকম গাণিতিক বিন্যাস ও সমবায় ঘটিয়ে ৭২ টি মেলকর্তার সৃষ্টি করা হয়েছে। এই সকল মেলকর্তাকে আবার ১২ টি চক্রে ভাগ করা হয়েছে। এই মেলকর্তাকে অনেক সময়েই জনক রাগ নামে অভিহিত করা হয়, কারণ এর উপর ভিত্তি করেই বাকি সমস্ত রাগের সৃষ্টি করা হয়েছে।

 

পণ্ডিত ভীমসেন জোশী, ভীমসেন গুরুরাজ যোশী, ভারতীয় শাস্ত্রীয় কণ্ঠশিল্পী, কিরানা ঘরানা | Pandit Bhimsen Joshi, Bhimsen Gururaj Joshi, Indian Classical Vocalist, Kirana Gharana

 

(হিন্দুস্থানী সঙ্গীতে পন্ডিত বিষ্ণু নারায়ণ ভাতখণ্ডে সাতটি শুদ্ধ স্বর সহ ১২ টি স্বরের বিন্যাস ঘটিয়ে ১০টি ঠাটের প্রবর্তন করেন এবং যে কোন রাগ এই ঠাট গুলির উপর ভিত্তি করেই সৃষ্ট হয়।)

৭। তাল ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কর্ণাটক সঙ্গীতে অঙ্গ, সূলাদি সপ্ততাল(অট, ধ্রুব, এক, ঝম্প, মট্য, রূপক ও ত্রিপুট) ও পাঁচটি জাতির উপর ভিত্তি করে ৩৫ টি তাল ব্যবহৃত হয়। সাধারণত গানগুলি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একই গতিতে (কালপ্রমাণ) গাওয়া হয়। ( হিন্দুস্থানী সঙ্গীতে তাল মাত্রা সংখ্যা ও বিভাগসংখ্যার উপর ভিত্তি করে হয়েছে, এক্ষেত্রে তালের ধারণা অনেকটাই সরল। এবং ধ্রুপদ, ধামার এই ধরণের গান খুব বিলম্বিত গতিতে বা লয়ে শুরু হয়, কিন্তু ক্রমশ দ্বিগুন, তিনগুন বা চতুর্গুণ হারে বৃদ্ধি পায়।)

৮। কর্ণাটক সঙ্গীতে বেশিরভাগ গানেই হিন্দু দেবদেবী বা ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি, আধ্যাত্মিকতা ইত্যাদি প্রকাশ পায়। এমনকি শৃঙ্গার রসও পৌরাণিক দেবদেবীর কাহিনীর উপর ভিত্তি রচিত।(হিন্দুস্থানী সঙ্গীতে ভক্তি ছাড়াও প্রেম, বিরহ, প্রকৃতি ইত্যাদি রস নিয়ে গান গাওয়া হয়।)

 

YaifwwriN4BzRFCyqbslL4 ভারতীয় উপমহাদেশের শাস্ত্রীয় সঙ্গীত সূচি
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

০৯। সাধারণত মঞ্চে কর্ণাটক সঙ্গীত দীর্ঘ সময়ের জন্য পরিবেশন করা হয়, প্রায় আড়াই তিন ঘন্টা। এই সময়ের মধ্যে একজন শিল্পী একাধিক রাগ বিভিন্ন শৈলীর গানের মাধ্যমে পরিবেশন করে থাকেন। অনুষ্ঠানের প্রথমে গাওয়া হয় বর্ণম। এরপর এক বা একাধিক কৃতি গাওয়া হয়। এরপর সাধারণত রাগম-তানম-পল্লবী (RTP) এই কাঠামোর মধ্যে গাওয়া হয়। এটি কর্ণাটক সঙ্গীতের মঞ্চ উপস্থাপনায় খুব গুরুত্বপূর্ণ অংশ বলে মনে করা হয়। অনুষ্ঠানের শেষে সাধারণত জাবালি বা তিলানা জাতীয় হালকা প্রকৃতির গান গেয়ে সমাপ্ত করা হয়। ( হিন্দুস্থানী সঙ্গীতের ক্ষেত্রে প্রথমে আলাপ, তারপর বিলম্বিত খেয়াল বা ধ্রুপদ জাতীয় গান, তারপর গতি বৃদ্ধি করে তান, লয়কারি এসব গাওয়া হয় ও ঠুংরি বা গজল জাতীয় লঘু গান গেয়ে শেষ করা হয়।)

১০। কর্ণাটক সঙ্গীতের অন্যতম বিশেষত্ব মনোধর্ম বা কল্পনা সঙ্গীত। এর বিভিন্ন প্রকার আছে, যেমন আলাপন, নিরাবল, স্বরকল্পনা, তানম তানি আবর্তম ইত্যাদি। কোন গানের মধ্যে এগুলি ব্যবহার করে একজন দক্ষ শিল্পী তাঁর সৃজনশীলতার পরিচয় দিয়ে থাকেন।

 

আরও দেখুন: