আব্দুল করিম খান [ Ustad Abdul Karim Khan, Kirana ] : দিল্লির কাছাকাছি সাহারানপুর জেলার কিরানা নামক গ্রামে এক সংগীতজ্ঞ পরিবারে ১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দের ১১ নভেম্বর তারিখে (ভিন্নমতে ১৮৮১ খ্রিষ্টাব্দে) জন্ম গ্রহণ করেন ওস্তাদ আব্দুল করিম খান । পিতা ওস্তাদ কালে খাঁ ও চাচা ওস্তাদ আব্দুল্লাহ খাঁর কাছে শৈশবেই তিনি সংগীতশিক্ষা লাভ করেন। সংগীতে ছিল তাঁর জন্মগত সহজাত অধিকার, যা তাঁকে কষ্ট করে আয়ত্ত করতে হয়নি। কেননা সংগীতজগতের প্রখ্যাত ও উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক ভ্রাতৃদ্বয় ওস্তাদ হদ্দু খাঁ ও হসু খাঁর পিতামহ ওস্তাদ নখন পীর বখস তাঁর মাতৃকুলের পূর্বসূরি। আর ওস্তাদ রহমত বক্স খাঁ, ওস্তাদ বন্দে আলী প্রমুখ গুণীজন ছিলেন তাঁর পিতৃকুলের পূর্বসূরি।
Table of Contents
ওস্তাদ আব্দুল করিম খান
পারিবারিক সংগীত পরিবেশের মধ্যে থাকায় শৈশব থেকেই আব্দুল করিম খান সংগীতের প্রতি আকৃষ্ট হন। অসাধারণ প্রতিভা ও কঠোর সাধনার মধ্য দিয়ে অল্প বয়সেই তিনি সংগীতে জ্ঞানার্জন শুরু করেন। গুরুজি ওস্তাদ রহমত খার কাছে এবং ওস্তাদ হুদুদু খা ঘরানার তালিম গ্রহণ করলেও আব্দুল করিম খাঁর কণ্ঠে রাগ-রাগিণীর প্রকাশভঙ্গি ছিল অপূর্ব কৌশলমণ্ডিত ।
রাগ-রাগিণীর চলন তাঁর কণ্ঠে অসামান্য দৃপ্তিতে ফুটে উঠত। এমনকি রাগ-রাগিণীর তাল ও ছন্দ তাঁর সুমধুর কণ্ঠের পরিবেশনায় হয়ে উঠত সুশোভিত। রাগ-রাগিণী পরিবেশনকালে কোনো জিনিস তিনি কখনোই পুনরাবৃত্তি করতেন না। এটা ছিল তাঁর বিশেষত্ব ও সংগীত পরিবেশনায় অভূতপূর্ব কৃতিত্ব।
মাত্র ছয় বছর বয়সে তিনি সাধারণ সংগীত আসরে একক গান পরিবেশনের সুযোগ পান এবং পনেরো বছর বয়সে তৎকালীন শ্রেষ্ঠ গায়কদের অন্যতম বলে স্বীকৃত হন। সে বয়সেই তিনি জুনাগড়ের রাজপরিবারে সংগীতশিক্ষক পদে নিয়োজিত হন। এরপরে তিনি বরোদা মহারাজার অনুরোধে রাজদরবারের সভাগায়ক পদ অলংকৃত করেন। বরোদা রাজদরবারে তিন বছর সময় অতিবাহিত করে আব্দুল করিম খাঁ ১৯০২ খ্রিষ্টাব্দে মুম্বাই যান, তারপরে মিরাট ও অন্যান্য জায়গায় সংগীত নিয়ে ভ্রমণ করেন। তাঁর সুমধুর কন্ঠস্বর ও অসাধারণ সংগীতনৈপুণ্যের জন্য অল্পকালের মধ্যেই তিনি একজন বিখ্যাত শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন।
আব্দুল করিম খাঁ কর্ণাটকি অর্থাৎ দক্ষিণ ভারতীয় সংগীতেও অত্যন্ত পারদর্শী ছিলেন। হিন্দুস্তানি ও কর্ণাটকি উভয় সংগীতের স্টাইল বা ঢঙের সংমিশ্রণ করে তিনি এক অপূর্ব সৌন্দর্যমণ্ডিত সুরের আবেশময় মূর্ছনা সৃষ্টি করতেন। তাঁর পরিবেশিত গান এবং সুরের ইন্দ্রজালে শ্রোতাবৃন্দ মুগ্ধ ও অভিভূত হয়ে পড়ত। তাঁর সংগীতে রাগ-রাগিণীর এক জীবন্ত রূপ প্রকাশ পেত এবং একই সঙ্গে বিভিন্ন রসের আবির্ভাব ঘটত। সংগীত ছিল তাঁর জীবনের এক পূত-পবিত্র আরাধনার বস্তু।
ওস্তাদ আব্দুল করিম খাঁ ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দে পুনাতে ‘আর্যসংগীত বিদ্যালয়’ স্থাপন করেন বিভিন্ন সংগীত জলসায় অংশগ্রহণ করে তিনি যে অর্থ সংগ্রহ করতেন তা দিয়েই এই সংগীত প্রতিষ্ঠানের ব্যয়ভার বহন করা হতো। দরিদ্র ও প্রতিভাবান শিক্ষার্থীর জন্য ছিল তাঁর অবারিত খোলা দুয়ার। তাদের যাবতীয় ব্যয়ভার তিনি নিজেই বহন করতেন। পরবর্তী সময়ে ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে আর্য সংগীত বিদ্যালয়ের একটি শাখা মুম্বাই নগরে স্থাপিত হয় এবং ওস্তাদ আব্দুল করিম খাঁ সাহেব তিন বছর মুম্বাই শহরে বসবাস করেন। এছাড়া বেলগাঁও, মিরাট প্রভৃতি স্থানেও তিনি সংগীতশিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন।
উপযুক্ত শিক্ষার্থী তৈরি করে সংগীতকে জনসাধারণের অত্যন্ত কাছে নিয়ে যাওয়াই ছিল এসব সংগীত প্রতিষ্ঠান স্থাপনের মূল উদ্দেশ্য। তিনি সংগীতসম্রাট মিয়া তানসেন প্রবর্তিত গওহর বা গোবরহার বাণীর গায়কি রীতিতে গান করতেন। তাঁর আলাপ পদ্ধতি ছিল অত্যন্ত আকর্ষণীয় এবং গানে করুণ কিংবা শৃঙ্গাররসের প্রাধান্য ছিল বেশি।
ঠুংরি, ভজন ইত্যাদি ভাবগীতিতেও তিনি সমান দক্ষ ছিলেন। তাঁর ঠুংরি ‘পিয়া বিন নাহি আওত চৈন’, ‘মাত যাইও রাধে যমুনাকে তীর’ ইত্যাদি গান তৎকালীন গুণীসমাজে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছিল। সংগীত জলসাগুলোতে তাঁর এই ঠুংরিগুলো শোনার জন্য দর্শক-শ্রোতাবৃন্দ বারবার অনুরোধ করতেন। আজো রেকর্ডগুলোতে তাঁর অতুলনীয় কণ্ঠস্বর শোনা যায়। মিড় ও কণযুক্ত (স্পর্শস্বরযুক্ত) গায়নশৈলী মহারাষ্ট্রে তিনিই প্রবর্তন করেন। তাঁর সময় থেকেই প্রসিদ্ধ কিরানা ঘরানা সংগীত আসরে সুপ্রতিষ্ঠা লাভ করে।
খাঁ সাহেবের দেহ ক্ষীণ প্রকৃতির হলেও মানুষ হিসেবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত উদার, হৃদয়বান, শান্ত এবং মধুর স্বভাবের। ব্যক্তিজীবন যাপনে তিনি অনাড়ম্বরপূর্ণ ও সাদামাটা ছিলেন। সংগীতের ক্ষেত্রে ঠুংরি ক্ষুদ্র গায়কি হলেও খাঁ সাহেবের পরিবেশনের গুণে তা লোকসমাজে ব্যাপক সমাদৃত হয়ে উঠেছিল। ওস্তাদ আব্দুল করিম খাঁ নিজ প্রতিষ্ঠিত ‘আর্য সংগীত বিদ্যালয়’ পুনার অধ্যক্ষ পদে আসীন ছিলেন। তবে তাঁর সংগীত প্রচারের প্রধান কেন্দ্র ছিল মিরাট।
জীবনের আয় ব্যয় :
ওস্তাদজি তাঁর জীবনের উপার্জিত সকল অর্থ-সম্পদ ব্যয় করে গেছেন সংগীতের উন্নতিকল্পে। তাঁর দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরের এক বর্ণাঢ্য কর্মমুখর সংগীতজীবনের পরিণত বয়স পর্যন্ত বহু শিষ্য তৈরি করে গেছেন। তাঁর শিষ্যদের মধ্যে প্রসিদ্ধ গায়িকা হীরা বাঈ বড়োদেকর, রওশন আরা বেগম, সরস্বতী রানে, সুরেশবাবু মানে, রামভাই কুন্দগোলকর (সওয়াই গন্ধর্ব), আবদুল ওয়াহিদ, গণেশচন্দ্র বেহরে ওরফে বেহরে বুয়া, তারা বাঈ প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।
আব্দুল করিম খান সাহেবের কুকুরের সাথে বিশেষ ঘটনা :
মুম্বাই থাকাকালে একটি কুকুরকে আব্দুল করিম খান বিচিত্র স্বরে গান গাওয়ার ঢঙে ডাকতে শেখান। যারা মুম্বাইয়ের আম্রলিতে অবস্থিত ওস্তাদজির বাড়িতে গিয়েছিলেন তাঁরা কুকুরের এই বিচিত্র গান গাওয়ার মতো করে ডাক শুনে যারপরনাই চমৎকৃত ও বিস্মিত হতেন। সংগীতের বার্ষিক উৎসবে যোগ দিতে ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মিরাট গমন করেন। সেখানে ভক্তবৃন্দের অনুরোধে মাদ্রাজের এক সংগীত সম্মেলনে অংশগ্রহণ করতে যান। সেখানকার অনুষ্ঠান শেষ করার পর এক বিশেষ অনুরোধে তিনি পণ্ডিচেরির উদ্দেশে রওনা হন। যদিও তাঁর শরীর তখন অত্যন্ত অসুস্থ ছিল, তবু মধুর স্বভাবের এই প্রিয়ভাষী মানুষটি কারো অনুরোধ এড়াতে পারতেন না।
আব্দুল করিম খান সাহেবের মহাপ্রয়াণ:
মাদ্রাজ থেকে পণ্ডিচেরি যাওয়ার পথে তাঁর হৃতযন্ত্রে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভূত হয়। একপর্যায়ে ট্রেনে তিনি অত্যন্ত অসুস্থবোধ করেন এবং ‘সিঙ্গাপোয়াকোলম’ স্টেশনে নেমে পড়েন। প্ল্যাটফর্মেই বিছানা পেতে বসে মহান সৃষ্টিকর্তার আরাধনা করতে নামাজ পড়েন। সাধক আব্দুল করিম খান সাহেব তাঁর জীবনের শেষদিন সমাগত বুঝতে পেরে শিষ্যদের তানপুরায় সুর বাঁধতে অনুরোধ করেন। সুর বাঁধা হলে তানপুরাটি হাতে নিয়ে দরবারি কানাড়া রাগে মহান আল্লাহপাকের গুণগান করতে করতে অন্তিম পথের উদ্দেশে যাত্রা করেন।
তখন ছিল মধ্যরাত, ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ অক্টোবর। সুরলোকের সন্ধানী ওস্তাদ আব্দুল করিম খান সাহেবের জীবনপ্রদীপ এভাবেই নির্বাপিত হয়।
ওস্তাদ আব্দুল করিম খান [ Ustad Abdul Karim Khan, Kirana ] সম্পর্কে আরও জানুন :
3 thoughts on “ওস্তাদ আব্দুল করিম খান [ Ustad Abdul Karim Khan, Kirana ]”