আগ্রা ঘরানা, Agra Gharana [ কণ্ঠশিল্প বা গীত বা গানের ঘরানা, সঙ্গীতের ঘরানা ]

আগ্রা ঘরানা [ Agra Gharana ] : পরাক্রমশালী মুঘল সম্রাট আকবরের রাজদরবারের সভাগায়ক বিদগ্ধ সংগীতজ্ঞ ওস্তাদ হাজি সুজান খাঁ সাহেবকে ‘আগ্রা ঘরানা’র প্রবর্তক বলা হয়। সংগীতসম্রাট মিয়া তানসেনের জামাতা বচ্চে খুদা বখস ওরফে ওস্তাদ হাজি সুজান খাঁ সংগীতশিক্ষা লাভ করেন ওস্তাদ নখন পীর বখস সাহেবের সান্নিধ্যে। তাই গোয়ালিয়র ও আগ্রা-ঘরানার মধ্যে নিকট সম্বন্ধ পরিলক্ষিত হয়। ভিন্ন মতানুসারে সংগীতগুণীজন শিল্পী অলখ দাস ও মলুখ দাসকে আগ্রা-ঘরানার প্রবর্তক বলে দাবি করলেও এর কোনো প্রামাণিক ইতিহাস পাওয়া যায়নি।

আগ্রা ঘরানা, Agra Gharana [ কণ্ঠশিল্প বা গীত বা গানের ঘরানা, সঙ্গীতের ঘরানা ] - দিল্লি ঘরানার বিখ্যাত শিল্পী আফতাব এ মৌসেকি ওস্তাদ ফৈয়াজ খান, Ustad FAIYAZ KHAN, Author- Unknown, Public Domain Image as Per Indian Copyright Law
দিল্লি ঘরানার বিখ্যাত শিল্পী আফতাব এ মৌসেকি ওস্তাদ ফৈয়াজ খান
সংগীতের ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতায় জানা যায় যে, রাজপুত সুজান সিংহ নৌহার ওরফে সুজান দাস ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণপূর্বক সুজান খা নাম ধারণ করেন। পরবর্তীকালে তিনি পবিত্র হজব্রত পালন করলে নামের সঙ্গে হাজি শব্দটি যুক্ত করে দেওয়া হয়। সুদক্ষ সংগীতশিল্পী এবং পারদর্শী সংগীত রচয়িতা হাজি সুজান খাঁ সাহেবের সংগীতনৈপুণ্যে মুগ্ধ হয়ে বাদশাহ নামদার তাঁকে ‘দীপকজ্যোত’ উপাধিসহ আলওয়ারের নিকটবর্তী গৌনপুর নামক গ্রামটি উপহার দিয়েছিলেন।

বিদগ্ধ সংগীতগুণীজন ওস্তাদ হাজি সুজান খাঁর চার পুত্র — অলক, মলক, খলক ও লবঙ্গ সকলেই সংগীতবিদ্যায় যথেষ্ট পারদর্শী হয়ে উঠলেও কেবলমাত্র মলকের বংশধারাতেই রক্ষিত হয়েছে আগ্রা-ঘরানার পরম্পরা। সংগীতজ্ঞ মলকের দুই পুত্র সরসরঙ্গ ও শ্যামরঙ্গ ধ্রুপদ এবং ধামার গানে যথেষ্ট কুশলী ছিলেন। কাশীর রাজা বীরভদ্র সিংহের কাছে রাজবৃত্তিপ্রাপ্ত সংগীতজ্ঞ সরসরঙ্গ ও শ্যামরঙ্গের সময় পর্যন্ত আগ্রা ঘরানায় কেবলমাত্র ধ্রুপদ এবং ধামার গানেরই প্রচলন ছিল। গোয়ালিয়রের প্রখ্যাত সংগীতসাধক ও গুণীজন নখন পীর বখস তাঁদের কাছে বেশকিছু ধ্রুপদ এবং ধামার গান শিখেছিলেন বলে জানা যায়। সংগীতজ্ঞ সরসরঙ্গ রচিত কয়েকটি গান এখনো শোনা যায় কুশলী সংগীতশিল্পী মহলে।

সংগীতজ্ঞ শ্যামরঙ্গের চার পুত্র হলেন – জংঘু খাঁ, সুসু খাঁ, গুলাব খাঁ ও ঘগঘে খুদা বখস। এঁদের মধ্যে প্রথম তিনজন চমৎকার কণ্ঠের অধিকারী এবং নিজেদের ঘরানার সংগীতে যথেষ্ট নৈপুণ্য অর্জন করেছিলেন। কিন্তু সর্বকনিষ্ঠ ভাই ঘগঘে খুদা বখসের ক্ষেত্রে দেখা দেয় চরম সমস্যা। কণ্ঠস্বর ভালো না হওয়ায় তাঁকে বলা হতো ‘ঘগঘে’, যার অর্থ হলো ‘খারাপ কণ্ঠস্বরবিশিষ্ট’। ফলে সকলেই তাঁকে উপহাস করত, এমনকি আগ্রা-ঘরানার প্রধান ওস্তাদবৃন্দও তাঁকে তালিম প্রদানে অস্বীকৃতি জানান।

মনের দুঃখে এবং সংগীতশিক্ষা লাভের প্রচণ্ড বাসনায় জেদি খুদা বখস অপরিসীম যাত্রাকষ্ট স্বীকার করে আগ্রা থেকে সুদূর গোয়ালিয়রে গমন করেন। কুশলী সংগীতজ্ঞ ওস্তাদ নথন পীর বখস তখন গোয়ালিয়রের রাজা দৌলতরাও সিন্ধিয়ার সভাগায়ক পদ অলংকৃত করছিলেন। সরাসরি তাঁর সঙ্গে দেখা করে বিস্তারিত বর্ণনা করেন ঘগঘে খুদা বখস। ওস্তাদজির কাছে আবেদন জানিয়ে বলেন:

‘ধ্রুপদ গান করা যদি আমার পক্ষে সম্ভব না হয়, তাহলে আপনি খেয়াল গানেরই তালিম প্রদান করুন।’

অল্প বয়সী ছেলেটির এই আগ্রহে মুগ্ধ হয়ে ওস্তাদজি তাঁকে বারো বছর যাবৎ নিজ সংগীতভাণ্ডার উজাড় করে তালিম প্রদান করেন। কঠোর সাধনা আর একনিষ্ঠ অধ্যবসায়ের গুণে খেয়াল গানে এক আশ্চর্য নৈপুণ্য অর্জন করে ঘগঘে খুদা বখস পৌঁছে যান তাঁর অভীষ্ট লক্ষ্যে। এক যুগ পর নিজ মাতৃভূমিতে প্রত্যাবর্তন করে কণ্ঠমাধুর্যের জাদুতে মুগ্ধ করে দেন সকলকে। ধ্রুপদ ও ধামার গানের সঙ্গে বিদগ্ধ সংগীতজ্ঞ ঘগঘে খুদা বখসের ঐকান্তিক ভালোবাসায় আগ্রা ঘরানায় যুক্ত হয় এক নতুন গায়নশৈলী ‘খেয়াল’।

আগ্রা ঘরানার সংগীতনৈপুণ্য চারদিকে ছড়িয়ে দিতে সংগীত সফরে বেরিয়ে পড়েন সংগীতজ্ঞ ঘগঘে খুদা বখস। প্রথমেই আলওয়ার রাজ্যে গমন করে রাজা শিবদান সিংহের রাজসভায় খেয়াল গান পরিবেশনের মাধ্যমে মুগ্ধ করেন সকলকে। রাজা বাহাদুরের জীবদ্দশায় আলওয়ারের সভাগায়ক পদ অলংকৃত করে আগ্রা-ঘরানার সংগীতশৈলী প্রচার ও প্রসারে মনোনিবেশ করেন। অসংখ্য শিষ্য তৈরি করে তাদের মধ্যে শুদ্ধ সংগীতের আলো প্রজ্বলিত করতে বিশেষ মনোযোগ দেন।

বেশ কিছুদিন পর রাজা শিবদান সিংহের দেহান্তর ঘটলে আবারো পথচলা শুরু করেন তিনি সংগীত নিয়ে। বিভিন্ন স্থানে আগ্রা-ঘরানার সংগীত মাধুর্য ছড়িয়ে জয়পুরে গিয়ে উপস্থিত হন। জয়পুররাজ সওয়াই রামসিংহ ঋদ্ধ ওস্তাদ ঘগঘে খুদা বখস পরিবেশিত সংগীতনৈপুণ্যে চমৎকৃত হয়ে সসম্মানে তাঁকে রাজসভাগায়কের পদে অধিষ্ঠিত করেন। সেখানে অবস্থানকালে আগ্রা-ঘরানার ধারা অক্ষুণ্ণ রেখে শিষ্যমণ্ডলী তৈরিসহ এর প্রচার ও প্রসারে তিনি সদা সচেষ্ট থাকেন।

আগ্রা-ঘরানার সংগীতশৈলীর ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ণ থেকেছে সংগীতজ্ঞ শ্যামরঙ্গের প্রথম পুত্র জংঘু খাঁ এবং চতুর্থ ও কনিষ্ঠ পুত্র ঘগঘে খুদা বখসের বংশ আর শিষ্যপরম্পরায়। এই ঘরানার শিষ্যদের তালিম প্রদানের ক্ষেত্রে একটি বিশেষ রীতি প্রচলিত ছিল। সাধারণত ওস্তাদ জংঘু খাঁ সাহেবের বংশধরেরা তালিম প্রদান করতেন ওস্তাদ খুদা বখসের বংশধরদের এবং খুদা বখসের বংশধরেরা তালিম দিতেন জংঘু খাঁ সাহেবের বংশধরদের। এই ঘরানার শিল্পীবৃন্দকে খেয়াল ও ধ্রুপদ উভয় গায়নশৈলীতেই ঈর্ষণীয় নৈপুণ্য অর্জন করতে হতো।

আগ্রা ঘরানার স্বনামখ্যাত সংগীতগুণীজনদের নাম [ Rnowned Personalities of Agra Gharana ] :

  • ওস্তাদ গুলাম আব্বাস খাঁ
  • কল্পন খাঁ
  • ফৈয়াজ খাঁ [ আফতাব এ মৌসেকি ]
  • নখন খাঁ
  • মহম্মদ খাঁ
  • আব্দুল্লাহ খাঁ
  • বিলায়েত হোসেন খাঁ
  • বাবু খাঁ
  • ননহে খাঁ
  • খাদিম হোসেন খাঁ
  • আনওয়ার হোসেন খাঁ
  • ভাস্কর বুয়া বোখলে
  • বাবলি বাঈ
  • ওস্তাদ আলতাফ হোসেন
  • ওস্তাদ লতাফৎ হোসেন
  • গোলাম রসুল খাঁ
  • খুশি খাঁ
  • ড. এস এন রতনজংকর
  • ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়
  • জ্ঞানেন্দ্র প্রসাদ গোস্বামী
  • ওস্তাদ শরাফৎ হোসেন
  • কে এল সায়গল
  • শ্রীমতি ড. চন্দ্ৰচূড়
  • মালকা বাঈ আগ্রাওয়ালি
  • ইউসুফ হোসেন
  • ইউনুস হোসেন
  • ইন্দরা ওয়াডকর
  • সরস্বতী বাঈ ফাতরপেকর
  • দুর্গা খোটে
  • গিরিজা বাঈ কেলকর
  • গজানন রাও যোশি
  • এ বি অভয়ংকর

হাজি সুজান খাঁ রচিত বেশকিছু ধ্রুপদ গান এখনো আগ্রা ঘরানার শিল্পীবৃন্দ পরিবেশন করে থাকেন। আগ্রা ঘরানার বর্তমান রূপটি গড়ে উঠতে কঠোর পরিশ্রম করেছেন ও বিশেষ অবদান রেখেছেন :  ওস্তাদ নখন খাঁ, ওস্তাদ ফৈয়াজ খাঁ এবং ওস্তাদ বিলায়েত হোসেন খাঁ।

আগ্রা ঘরানার বৈশিষ্ট্য [ Speciality of Agra Gharana ] :

  • নোম তোম সংবলিত আলাপ
  • ধ্রুপদাঙ্গের খেয়াল গায়ন
  • উচ্চাঙ্গের লয়কারীর কাজ
  • কাওয়ালির ঢঙে বোল তৈরির নৈপুণ্য এবং
  • ধ্রুপদ ও ছোট খেয়ালে বিশেষ দক্ষতা।

আগ্রা ঘরানা সম্পর্কে আরও পড়ুন [ Read more about Agra Gharana ]: